টাঙ্গুয়ায় অতিরিক্ত নৌকা ভাড়া, বিপাকে পর্যটকরা
ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওর। বর্ষা মৌসুমে হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখার জন্য পর্যটকরা ভিড় করেন।
চারদিকে নীল পানি আর মেঘালয় পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যে ঘেরা টাঙ্গুয়ার হাওর। সারি সারি হিজল-করচ, পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হাওরটি নানা জাতের মাছ, পাখি ও জলজ প্রাণীদের এক বিশাল অভয়াশ্রম। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হাওরটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। টাঙ্গুয়ার হাওরের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে, যার কারণে বর্ষা মৌসুমে এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।
আর এই ভিড়ের সুযোগে নৌকা মালিকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছেন পর্যটকদের কাছ থেকে। অতিরিক্ত নৌকা ভাড়ার কারণে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে এসে ভোগান্তিতে পড়ছেন পর্যটকরা। নৌকা মালিক ও চালকরা সিন্ডিকেট করে পর্যটকদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি স্বীকার করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। এখানে যেভাবে নৌকা ভাড়া নিয়ে পর্যটকদের হয়রানি করা হয়, তা অনেকটা মাছের হাটের মতো- এমনটা মনে করছে উপজেলা প্রশাসন।
এ অবস্থায় আগামীকাল সোমবার (৫ আগস্ট) স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা নৌকা মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। বৈঠক থেকে নৌকার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ভাগা নির্ধারণ করে দেয়া হবে।
পর্যটক ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঘুরতে এসে পর্যটকরা তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকেরঘাট, শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী লেক), বারেক টিলা, যাদুকাটা নদী, লাকমা ছড়া নৌকায় করে ঘোরেন। কিন্তু টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে আসা পযর্টকরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন নৌকার মালিক ও চালকদের কাছে।
বছর দুয়েক আগেও যেখানে প্রতিদিনের (একদিন-একরাত) নৌকা ভাড়া ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা ছিল, সেখানে বছর খানেক ধরে সেটা ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। কোনো কোনো দিন এই ভাড়া আরও বেশি আদায় করা হচ্ছে বলে পর্যটকেরা অভিযোগ করেন।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক নূরে আলম বলেন, ‘বন্ধুবান্ধব মিলে ঘুরতে এসেছিলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া দিতে হয়েছে ৬ হাজার টাকা। আবার রাতে থাকার জন্য বাড়তি টাকা দাবি করে নৌকার চালক। এতো দূর থেকে এসেছি, ফিরে যেতে তো পারবো না। তাই বাধ্য হয়েই টাকা দিতে হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কেউ সকাল থেকে সারাদিন, আবার কেউবা সারাদিন ও একরাত হাওরে থাকার জন্য ভাড়া করতে গিয়ে শুরু হয় নৌকার মাঝিদের সাথে দর কষাকষি। একটি নৌকা চালাতে (বড়) সর্বমোট ৩ জন লোকের প্রয়োজন। আর ছোট নৌকায় দুজন। এক্ষেত্রে দৈনিক মজুরি জনপ্রতি ৪শ টাকা, তেল খরচ সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা হলে হাওরে এক দিনে সবোর্চ্চ ২২০০-২৫০০ টাকা খরচ হয়। সেখানে ৮-৯ হাজার টাকার বেশি নেয়া হচ্ছে।
আর একদিন ও একরাতে হাওরে থাকার জন্য ৫ হাজার সাড়ে ৫ হাজার টাকা সর্বোচ্চ নিলেই যথেষ্ট। সেখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দাবি করছে নৌকার মালিক ও মাঝিরা। টাঙ্গুয়ার হাওরে সিন্দাবাদ নামে নৌকা ভাড়া দিচ্ছে ঢাকার একটি ট্যুর গ্রুপ। তাদের নৌকা একরাত একদিনের জন্য ভাড়া নিতে হয় ১৮ হাজার টাকায়। এ বিষয়ে সিন্দাবাদ গ্রুপের ইমরান জানান, আমরা মনে করছি না ভাড়া বেশি। যদি বেশি হতো, মানুষ নৌকা ভাড়া নিতো না।
এদিকে নৌকার ভাড়ার ব্যাপারে সোমবার (৫ আগস্ট) একটি সভা ডাকা হয়েছে জানিয়ে তাহিরপুরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ ইমতিয়াজ বলেন, এখানে নৌকা মালিকদের ভাড়া নিয়ে প্রচুর অভিযোগ পেয়েছি। মাছের বাজারের মতো বানিয়ে একটি পর্যটন স্পটকে তারা সিন্ডিকেট করে ফেলছে। তাই আমরা সোমবার উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং নৌকার মালিকসহ বসে নৌকার ধারণ ক্ষমতা এবং দৈর্ঘ্য অনুসারে ভাড়া নির্ধারণ করে দেব, যা নৌকার সামনে দৃশ্যমান জায়গায় লাগিয়ে রাখতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সুনামগঞ্জ জেলার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, এখানে অতিরিক্ত নৌকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। প্রশাসন যখন একটা নির্দিষ্ট হার ঠিক করে দেবে, তখন যদি তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে, ভোক্তা অধিকার সহজে পদক্ষেদপ নিতে পারবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, হাওরে ঘুরতে এসে পর্যটকরা যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন, সে বিষয়টি দেখবে প্রশাসন। কোনোভাবেই অতিরিক্ত নৌকা ভাড়া আদায় করা যাবে না। পর্যটকদের সুবিধার্থে আমরা নৌকা ভাড়ার তালিকা টাঙিয়ে দেব।
মোসাইদ রাহাত/এমএসএইচ