ফেনীতে ‘গায়েবি’ মামলায় সাংবাদিকদের নামে চার্জশিট
ফেনীর আলোচিত মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের পর শরীরে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনায় সংবাদ প্রকাশে অসন্তুষ্ট হয়ে চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। ভুক্তভোগীরা এসব মামলাকে ‘গায়েবি’ বলে উল্লেখ করেন।
অভিযোগ আছে, মামলায় নাম দেখিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দিতে তদন্ত কর্মকর্তাদের বাধ্য করেন সদ্য প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। এ নিয়ে ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিকদের মাঝে ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে।
জেলা পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নুসরাত হত্যার ঘটনায় সংবাদ প্রকাশে ক্ষিপ্ত হয়ে এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার ফেনী ছাড়ার আগেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় এসপি তাকে নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কয়েকজন সাংবাদিকের নাম-সংবলিত একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ধরিয়ে দিয়ে বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলায় সাংবাদিকদের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। কয়েকজন ওসি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অন্যরা এসিআরের ভয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিলে বাধ্য হন।
গত ১২ মে সন্ধ্যায় এসপির বদলির আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশিট তৈরি করান। পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতে কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন তিনি।
সূত্র আরও জানায়, এখন পর্যন্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় তিনটি, সোনাগাজী মডেল থানায় দুটি, দাগনভূঞা থানায় দুটি এবং ছাগলনাইয়া থানায় দায়ের করা দুটি মামলার চার্জশিট আদালতে জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। সবকটি মামলায় স্থানীয় দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনী’র সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, বাংলানিউজ’র স্টাফ রিপোর্টার ও সাপ্তাহিক হকার্স’র বার্তা সম্পাদক সোলায়মান হাজারী ডালিম, দৈনিক অধিকার প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্ট সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী এবং দৈনিক সময়ের আলো প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টার লাইনের স্টাফ রিপোর্টার মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারীর নাম রয়েছে।
এর মধ্যে ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ছাগলনাইয়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা (১৬/৩৪৪) দায়ের করেন এসআই আলমগীর হোসেন। ওই মামলায় চার সাংবাদিকসহ ৩৮ জনকে অভিযুক্ত করে চলতি বছরের ৯ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন থানার ওসি (তদন্ত) সুদীপ রায়। ২০১৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ফেনী মডেল থানার এসআই মাসুদ সিকদার বাদী হয়ে ২৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা (৩২/৬২৩) দায়ের করেন। ২২ মে দুই সাংবাদিকসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর জনৈক ওমর ফারুক ১৭ জনকে আসামি করে দাগনভূঞা থানায় মামলা (১৪/১৫২) দায়ের করেন।
মামলার বাদী ওমর ফারুকের দাবি, তাকে না জানিয়ে ১০ মে ৩৭ জনের নামে চার্জশিট প্রদান করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ফেনীর চারটি থানার নয়টি মামলায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান করে পুলিশ।
এছাড়া ছাগলনাইয়ায় কর্মরত দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ আইসিটি আইনে দায়েরকৃত মামলার (১৯/২০১৬) বাদী মজিবুল হকের সঙ্গে একই বছরের ৮ জুলাই সমঝোতা হয়। বাদীর সঙ্গে সমঝোতা হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৭ মে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেন।
দৈনিক যুগান্তর ছাগলনাইয়া প্রতিনিধি নুরুজ্জামান সুমন ও অনলাইন পোর্টাল ছাগলনাইয়া ডট কম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির লিটন জানান, প্রতিহিংসাবশত এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নির্দেশে ওসি (তদন্ত) সুদীপ রায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
কর্মরত একাধিক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘গায়েবি’ এসব মামলায় যে ক’জন সাংবাদিকের নামে চার্জশিট জমা দেয়া হয়েছে তাদের নামে ফেনীর কোনো থানায় ইতোপূর্বে সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। বিতর্কিত এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের রোষানলে পড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা প্রায় ১০টি মামলার চার্জশিটে আমাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন।
সাংবাদিক এস এম ইউসুফ আলী জানান, দৈনিক অধিকার পত্রিকায় বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ‘কথিত গায়েবি’ মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। পরে জানতে পারেন, তাকে তদন্তাধীন ৮-১০টি মামলার চার্জশিটে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
দৈনিক ফেনীর সময় সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, নুসরাত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমের পাশাপশি আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতেও সংবাদ পরিবেশিত হয়। নৃসংশ এ হত্যাকাণ্ডে এসপি-ওসির কর্তব্যে অবহেলা নিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হলে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ সুপার তাকে মামলায় জড়িয়ে দেন।
সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক, ফেনী জেলা শাখা সভাপতি অ্যাডভোকেট লক্ষণ বণিক বলেন, যেখানে এসপি-ওসি বীভৎস ওই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছিল সেখানে সাংবাদিকদের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসে। এমনকি পুলিশের তদন্তেও পুলিশ সুপার ও ওসির কর্তব্যে অবহেলা ও বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এরপরও প্রতিহিংসাবশত সাংবাদিকদের তদন্তাধীন মামলার চার্জশিটে জড়িয়ে হয়রানি করা খুবই ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এসব মামলায় সাংবাদিকদের অব্যাহতির দাবী জানান তিনি।
গত ৬ এপ্রিল মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনাকে সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আত্মহত্যা বলে প্রচার করেন। তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রতিবেদন দেন পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। বর্বরোচিত ওই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাতেও অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ কয়েকজনকে আসামি না করতে চেষ্টা করেন এসপি-ওসি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা এবং সাংবাদিকদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে ক্রমেই ঘটনার জট খুলতে থাকে। একপর্যায়ে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হলে ঘটনায় জড়িতরা গ্রেফতার হন।
অন্যদিকে পুলিশ সদরদফতরের তদন্তে দোষীসাব্যস্ত হয়ে বরখাস্ত হন ওসি মোয়াজ্জেম। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে প্রত্যাহার হয়ে সদরদফতরে সংযুক্ত হন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। আরও দুই পুলিশ সদস্যকেও প্রত্যাহার করে পার্বত্য অঞ্চলে সংযুক্ত করা হয়।
গত ১৫ এপ্রিল উচ্চ আদালতের সাইবার ক্রাইম ডিভিশনে বেআইনিভাবে নুসরাত রাফির জবানবন্দি ধারণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে আইসিটি আইনে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। ওই মামলায় কারাগারে রয়েছেন ওসি মোয়াজ্জেম।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। টানা পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।
ওই ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন। গত ২৭ জুন মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী নুসরাত রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ইতোমধ্যে ৫১ জনের সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
রাশেদুল হাসান/এমএআর/এমএস