কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত, খাদ্য সংকট
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কুড়িগ্রাম
প্রকাশিত: ০৭:৫২ পিএম, ২০ জুলাই ২০১৯
কুড়িগ্রাম জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েক গুণ। দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। নেই বিশুদ্ধ পানি। নেই শৌচকাজ করার সু-ব্যবস্থা। প্রকৃতির ডাক এলেই চরম ভোগান্তিতে পড়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। কারও ঘরে রান্না হলেও নেই তরকারি। ফলে শুকনো ভাত লবণ দিয়ে খাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। এ দুর্ভোগ জেলার প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বানভাসি মানুষের।
চিলমারী উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি স্থানীয়দের। চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী (বীরবিক্রম) বলেন, আমার জানা মতে গত ১০০ বছরে এত পানি চিলমারীর মানুষ দেখেনি। এখানে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সর্বত্র পানি আর পানি। উপজেলার ৩০ হাজার ৯৩৯টি পরিবারের মধ্যে ৩০ হাজারের ওপর পরিবার পুরোপুরি পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানির তোড়ে অষ্টমীর চর ইউনিয়নের ৭৮টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।
শনিবার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে খামার বাঁশপাতারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রমনা রেল স্টেশনের উত্তরে রেললাইনের নিচ থেকে ১৫০মিটার এলাকার মাটি পানির তোড়ে সরে যাওয়ায় রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবে গেছে ল্যাট্রিন, টিউবওয়েলও এখন পানির নিচে। এতে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে। সবার ঘরে খাবার নেই। শুকনা খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ উপজেলায় ১১০ মেট্রিক টন চাল ও ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।
চিলমারী হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার আব্দুস সালাম জানান, বন্যা স্থায়ী হওয়ায় ইতোমধ্যে পানিবাহিত রোগ-ব্যাধি বাড়ছে। শনিবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৪ শিশু ও এক বয়স্ক ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে গত কয়েকদিনে চিলমারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ১৩ শিশু, ৭ নারী ও ৭ পুরুষ রোগী। এ সংখ্যা ক্রমেই বুদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি জানান।
চিলমারী উপজেলা সদরের থানাহাট ইউনিয়নের খড়খড়িয়া গ্রামের আবুহার আলী (৫০) বলেন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ ছয়জনের পরিবার নিয়ে গত সাতদিন ধরে পানিবন্দি জীবনযাপন করছি। আজ পর্যন্ত সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো খাদ্য সহায়তা মেলেনি। ঘরে চালের যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে অল্প অল্প করে রান্না করে খাচ্ছি। তবে কোনো তরিতরকারি নেই। বলা চলে শুধুমাত্র লবণ চটকিয়ে কোনো রকম জীবন বাঁচানো মাত্র। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
ভট্টপাড়ার জাবের হোসেন (৩৫) শ্রমজীবী মানুষ। তার কাজ নেই, ফলে ঘরে খাবারও নেই। তার ওপর সাতদিন ধরে পানিবন্দি জীবন। চারজনের সংসার নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন তিনি। অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের। জাবেরের ভাগ্যেও ত্রাণ জোটেনি। একই অবস্থা চিলমারীর অধিকাংশ দুর্গত এলাকায়।
গণকমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি কলামিস্ট নাহিদ নলেজ বন্যার ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করে বলেন, এ অঞ্চলের মানুষদের বাঁচাতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে এখনই চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হোক। কারণ এ তিনটি উপজেলার ৯৫ ভাগ মানুষ এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বানের পানিতে ভাসছে। ঘরে ঘরে খাদ্যের জন্য হাহাকার বিরাজ করছে। ঘটছে মানবিক বিপর্যয়। সাধারণ মানুষ একমাত্র সম্বল গবাদিপশুও রক্ষা করতে পারছে না। কারণ গবাদিপশু রাখার জায়গা নেই। নেই গো-খাদ্য।
জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, বন্যার ফলে ৫৭টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০ হাজার হেক্টর। বন্যায় এক হাজার ২৪৫ কিলোমিটার রাস্তা, ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ও ৪১টি ব্রিজ/কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নলকূপ ক্ষতিগস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৭৩৪টি। প্রায় দুই লক্ষাধিক গবাদিপশু পানিবন্দি।
শনিবার বিকেল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৮০ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার কমে গিয়ে ৮৩. ৪৫ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীল পানি ব্রিজ পয়েন্টে ৪৫ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা দুর্গতদের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। ৫টি ওয়াটার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও স্যালাইন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিতরণ করা হচ্ছে বলে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন।
ববন্যা দুর্গতদের সহযোগিতায় প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ সামর্থ অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ করছেন। বেসরকারি এনজিওগুলো এখনো হাত গুটিয়ে বসে আছে। ডোনার সহায়তা না করায় তারা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
অপরদিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকে এগিয়ে আসলেও তা একেবারেই নগণ্য। ফলে বানভাসিদের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বন্যার্তদের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে ৮০০ মেট্রিক টন জিআর চাল, ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৬ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নাজমুল হোসাইন/আরএআর/জেআইএম