‘পরীক্ষার হল থেকে আগুন আগুন চিৎকার শুনতে পাই’
আলোচিত মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় আরও তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার প্রভাষক মোহাম্মদ কবির আহাম্মদ, আলিম পরিক্ষার্থী ফাহমিদা আক্তার হামদুনা ও নাসরিন সুলতানা সাক্ষ্য প্রদান করেন।
নুসরাত হত্যা মামলায় মামলার বাদী বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, মা শিরিন আক্তার ও ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানসহ ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। গত ২৭ জুন থেকে এ মামলার সাক্ষগ্রহণ ও জেরা শুরু হয়ে টানা এ কার্যক্রম চলছে।
আদালত সূত্রের বরাত দিয়ে জেলা জজ আদালতের সরকারী কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট হাফেজ আহাম্মদ বলেন, ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার এক শিক্ষকসহ তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। আদালত আগামী রোববার (২১ জুলাই) ওই মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার, বিবি হাজেরা, আবু বকর ছিদ্দিক ও মো. আকবরের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন। এরা নুসরাত হত্যা মামলার ২৯ থেকে ৩২ নম্বর সাক্ষী।
আদালত সূত্রে জানা যায়, সাক্ষ্য দিতে গিয়ে প্রভাষক মো. কবির আহাম্মদ বলেন, ৬ এপ্রিল ঘটনার দিন আমি ৮ নং হলের দায়িত্বে ছিলাম। ওই হলে নুসরাত জাহান রাফিও পরীক্ষা দিচ্ছিল। ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টার কিছু পরে হলে উপস্থিত হই। পৌনে ১০টায় খাতা দেয়া শেষ করি। এ সময় দেখতে পাই একজন অনুপস্থিত রয়েছে। জানতে চাইলাম-এটা কে? অন্যরা বলল, নুসরাত অনুপস্থিত। এর কিছুক্ষণ পর আগুন আগুন চিৎকার শুনতে পাই। খবর নিয়ে জানতে পারি নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়া হয়েছে।
নুসরাতের সহপাঠী হামদুনা এবং নাসরিন সুলতানা বলেন, সেদিন নুসরাত সাড়ে ৯টার দিকে হলে এসেছিল। কেউ একজন তাকে ডেকে বাইরে নিয়ে যায়। যাবার সময় নুসরাত আমাদের বলেছিল, আমার বান্ধবী নিশাতের কোনো সমস্যা হয়েছে মনে হয়। আমি আসছি। এর ২০ থেকে ২২ মিনিট পর হৈ-চৈ শুনে অনেকের সঙ্গে আমরাও বাইরে আসি এবং দেখি একটি আগুনে পোড়া দেহ বেশ কয়েকজন মিলে ধরে সিএনজি যোগে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। পরে খবর নিয়ে জানতে পারি- ওটা ছিল নুসরাত। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন আসাসিপক্ষের আইনজীবীরা।
আলোচিত এ মামলায় রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষে ছিলেন পিপি হাফেজ আহাম্মদ, এপিপি এ কে এস ফরিদ আহাম্মদ হাজারী ও এম শাহজাহান সাজু।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফেনী সদর হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। সেখানে ১০ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে নুসরাত মারা যান।
এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।
নুসরাত হত্যা মামলায় সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীমের (২০) সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে চার্জশিট দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এ মামলায় মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
রাশেদুল হাসান/আরএআর/এমকেএইচ