হারিয়ে যেতে বসেছে টাঙ্গাইলের মৃৎশিল্প


প্রকাশিত: ০৬:৫৯ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

গভীর ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে নিপুণ হাতে কারু কাজের মাধ্যমে তৈরি করেন নানা তৈজসপত্র। তাদের জীবন জীবিকার এক মাত্র হাতিয়ার হলো মাটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের ভালোবাসার সেই জীবিকা ফিকে হতে বসেছে। বলা হচ্ছে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরদের কথা।

দিন যতই যাচ্ছে, ততই বাড়ছে আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পপণ্যগুলো। এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের প্রচুর প্রচলন ছিল। কিন্তু সেই তৈজসপত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে এ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি তৈজসপত্র। তাই কাচ, প্লাস্টিক আর মেলামাইনের ভিড়ে এখন মাটির তৈরি জিনিসপত্রগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।

জানা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ফলদা কুমার পাড়ায় ২০০টি কুমার পরিবার বসবাস করছে। এর মধ্যে ৮০টি পরিবার সরাসরি মৃৎ শিল্পের উপর নির্ভশীল। দিন রাত একাকার করে মাটি দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন মৃৎ-পণ্য। কিন্তু সঠিক দাম নাম পাওয়ায় আর বর্তমান অবস্থায় কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে এ সকল কারিগররা।

বর্তমানে গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব, মেলায় তৈরি খেলনা পুতুল ছাড়া অন্য কোনো মৃৎ শিল্পের গ্রাহক নেই বললেই চলে। বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। ফলে এ পেশায় জড়িতদের জীবন-যাপন কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মৃৎ শিল্পীরা মাটি দিয়ে তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, কুয়ার পাত, হাঁড়ি পাতিলসহ বিভিন্ন নৃত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পরে সেগুলোকে তারা শহরের দোকান এবং বাসা বাড়িতে বিক্রয় করে থাকেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে মৃৎ শিল্পের ব্যবহার তেমন এখন চোখেই পড়ে না, এখন সৌখিন জিনিসপত্র এবং কুয়ার পাতই একমাত্র ভরসা।

ফলদা মৃৎ শিল্পের পুরনো কারিগর মঙ্গল পাল (৬০) জানান, এখন মাটির তৈরি কোনো কিছু মানুষ কিনতে আসে না। প্লাস্টিক আর কাঁচের তৈরি বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও শো পিস কিনতে সবাই ব্যস্ত।

মহন পাল নামে আরেক কারিগর বলেন, আমাদের তৈরি মৃৎ-শিল্পের বাজারদর ভালো ছিল কিন্তু প্লাস্টিক আর কাচের ব্যবহার বাড়ার কারণে আজ আমাদের ব্যবসা ধ্বংসের পথে। এতে অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।

এ বিষয়ে ভূঞাপুর শহরের মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী রাজন পাল জাগো নিউজকে বলেন, আগে আমাদের ব্যবসা ভাল চলত। আগে যখন শিসা, প্লাস্টিকের পণ্য ছিল না তখন আমরা রমরমা ব্যবসা করতাম। আর এখন মাটির তৈরি জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নেই। এখন মাটির জিনিস চলে কম।

তিনি আরো বলেন, আমার বয়স যখন ১০-১২ বছর তখন আমি ২ টাকা থেকে ৫ টাকা করে পাতিল বিক্রি করতাম। আগে অনেক লোকজনই এই ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। আগে যে পরিমাণে বিক্রি হতো তার থেকে এখন ৪ ভাগের ১ ভাগ বিক্রি হয়। আবার অনেক সময় চলেই না। এখন আমাদের এ ব্যবসা একেবারেই অচল। যারা এ ব্যবসায় স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছে, তারা একদমই চলতে পারে না।

মৃৎশিল্প ভ্রামমাণ ব্যবসায়ী গবেশ পাল জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এই ব্যবসায় এখন ১৬ আনার মধ্য ৬ আনা চলে, ১০ আনাই চলে না । আমাদের ছেলে-মেয়ে আছে, ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া করাতে গেলে যে অর্থের দরকার, এই ব্যবসায় থেকে তা উঠানো যায় না। চাকরির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগতেছে। এই টাকা দেবে কে?

মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী নিতাই পাল জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এই ব্যবসা এখন চলে না। বৃদ্ধ বয়সে এখন কি করব, তাই জোর করেই এই ব্যবসা করি। সিলভার, প্লাস্টিক, স্টিলের পণ্য নামার কারণে এই ব্যবসা অচল হয়ে যাচ্ছে। কলস, হাড়ি পাতিল এগুলো এখন একদমই চলে না।

তিনি আরো জানান, আধুনিক তৈজসপত্রের প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বিলুপ্তির পথেই এগিয়ে চলছে এখন মৃৎশিল্প।

এসএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।