গাছে মারা ৬ মণ তারকাঁটা তুললেন বৃক্ষপ্রেমিক

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি যশোর
প্রকাশিত: ০৩:৫৬ পিএম, ০৪ জুলাই ২০১৯

বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছিলেন ‘উদ্ভিদের প্রাণ আছে’। আর এই সজীব উদ্ভিদের বুকে পেরেক ও তারকাঁটা মেরে বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, ব্যানার লাগানো হয়। বুকে তারকাঁটা বিঁধে অশ্রু ঝরে বৃক্ষের। উদ্ভিদের এই কান্না শুনতে পান বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল ওয়াহেদ সরদার। কষ্ট দূর করতে তিনি গাছে মারা পেরেক ও তারকাঁটা তোলেন।

দেড় দশক আগে গাছের চারা লাগানোর অভিযানে নামা আব্দুল ওয়াহেদ সরদার গত বছর শুরু করেন পেরেক তোলা অভিযান। এক বছরে তিনি হাজার হাজার গাছ থেকে সোয়া ৬ মণ পেরেক-তারকাঁটা তুলেছেন। আবারও অভিযানে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এই বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল ওয়াহেদ সরদারের বাড়ি যশোর সদর উপজেলার সাড়াপোল গ্রামে। তার এই বৃক্ষপ্রেমের কারণে সরকার তাকে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকে ভূষিত করেছে।

আব্দুল ওয়াহেদ সরদারের বাড়িতে পেরেক, তারকাঁটা ও লোহার বিশাল এক ঢিবি। দেখে মনে হবে, তিনি ভাঙড়ি ব্যবসায়ী। কিন্তু তা নয়, গত এক বছরে হাজার হাজার গাছ থেকে তিনি এসব পেরেক, তারকাঁটা অপসারণ করেছেন। গত বছর ৫ জুন যশোর শহরের টাউন হল ময়দানের পূর্ব-দক্ষিণ কোণের মেহগনি গাছের পেরেক অপসারণ দিয়ে তিনি এ অভিযান শুরু করেন। আর এই লোহা-লক্কড় এনে বাড়িতে জড়ো করেছেন। যার ওজন ৬ মণ ১০ কেজি।

বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল ওয়াহেদ সরদার জানান, গাছে বিলবোর্ড টাঙানো বেআইনি। বিশেষ করে পেরেক ঠুকে বিল বোর্ড টাঙানো বড় অপরাধ। পেরেক তুলতে গিয়ে যাদের বিল বোর্ড সরানো হয়েছে তারা কিছু বলেনি, বলেছে অতি উৎসাহী পুলিশ। অথচ পুলিশ হলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২’ অনুযায়ী কোনো প্রকার প্রচার কাজে গাছ ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংস্থা এ আইন পরোয়া করছে না। তারা প্রচার কাজে শুধু গাছ ব্যবহারই করছে না, নির্দয়ভাবে গাছে বড় বড় পেরেকও ঠুকছে। তাই তিনি এই পেরেক অপসারণের জন্যে পথে নামেন।

তিনি আরও জানান, খুলনার চুকনগর-দৌলতপুর থেকে শুরু করে চুয়াডাঙ্গা, হরিণাকুণ্ডু পর্যন্ত তিনি গত এক বছরে লক্ষাধিক গাছ থেকে পেরেক, তারকাঁটা তুলেছেন। সাইকেলে চড়ে দিনের পর দিন পথে পথে কাটিয়ে তিনি এই কাজ করেছেন। দিনের পর দিন গোসল হয়নি, খাওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি এ কাজে কোনো বিরাম দেননি। পথের ধারের টি স্টলের বেঞ্চ অথবা স্কুল-কলেজের বারান্দায় রাত কাটিয়েছেন।

আবদুল ওয়াহেদ সরদার জানান, একদিক থেকে তিনি যে গাছের পেরেক তোলেন, অন্যদিকে সেই গাছে আবার পেরেক ঠুকে বিলবোর্ড টাঙানো হয়। বিষয়টির প্রতি বন বিভাগ ও প্রশাসনের কোনো নজর নেই। অথচ কাজটা কিন্তু তাদেরই। আইন বাস্তবায়নে তারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত।

তিনি আরও জানান, গাছের প্রতি প্রাণের টানে তিনি বাংলা ১৪১২ সাল থেকে গাছ লাগানো শুরু করেন। নিজ খরচে তিনি প্রায় ৯০ বিঘা জমিতে গাছ লাগিয়েছেন। তার রোপণ করা গাছের সংখ্যা সাড়ে ১৩ হাজার। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, জামরুল, কালোজাম, কাগজি লেবু, আমড়া, কামরাঙ্গা, জলপাই প্রভৃতি। নিজের জমি না থাকায় তিনি এই গাছ লাগান সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, পতিত জায়গা ও রাস্তার পাশে। যশোর কালেক্টরেট চত্বর, এসপি অফিস, পুলিশ লাইন্স এবং চৌগাছা, মণিরামপুর ও অভয়নগর থানা চত্বর, বাগআঁচড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, বেজপাড়া আনসার ও ভিডিপি ক্যাম্প চত্বর, স্টেডিয়ামপাড়া মিতালী সংঘ সংলগ্ন এলাকা, ট্রাফিক অফিস, চেকপোস্ট, বিল হরিণার শ্মশানঘাট, সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের আটটি রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে তার রোপণ করা গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আবদুল ওয়াহেদ সরদারের এই বৃক্ষপ্রেমের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২১’এ ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তার গলায় এ পদক পরিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। শুধু এই স্বীকৃতিই নয়, অনেক সামাজিক সংগঠনও তাকে পুরস্কৃত করে উৎসাহিত করেছে এ মহৎ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। সর্বশেষ গত ২৯ জুন তাইওয়ানের একটি সংস্থার পক্ষ থেকে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

আবদুল ওয়াহেদ সরদার জানান, এখন তিনি কেশবপুরের বিরল প্রজাতির হনুমানের জন্য কিছু গাছ লাগাবেন। হারিয়ে যেতে বসা এই হনুমান খাদ্য সংকটে ভুগছে। তাই তাদের জন্য জগ ডুমুর গাছ লাগাবেন। এই ডুমুর মানুষ ও পশুর জন্য খুবই উপকারী। এই গাছ বড় হলে হনুমানরা ফল খেতে পারবে। আর এরপরই আবার পথে নামবেন গাছের পেরেক তুলতে। এবার তার অভিযান নড়াইল সড়কে।

মিলন রহমান/আরএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।