হত্যাকারী থেকে প্রেমিক!
ডিম থেকে বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছিল। নিয়ম মতো যত্ন করে বড় করা মুরগির বাচ্চাগুলো পুষ্পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিদিন খামারের মোরগ গুনে গুনে দেখেন পুষ্পিতা। কিন্তু এতদিন সব ঠিক থাকলেও গত কয়েক দিন যাবত কীভাবে যেন মোরগ কমে যাচ্ছে। পুষ্পিতা বুঝতে পারেন কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু সেটা আসলে কী তা বুঝতে পারছিলেন না। পরে পুষ্পিতার ছোট ভাই রহস্য খুঁজে পান। আর সেই রহস্য হচ্ছে একটি গুইসাপ।
পুষ্পিতা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ভাইয়ের যুক্তি মেনে নেন। ভাই বোন মিলে সতর্ক পাহারা বসান। অবশেষে সেই সাপটি তারা ধরে ফেলেন। পুষ্পিতা ভাইকে বললেন ‘আমি সাপ পিটিয়ে মারব, আর তুমি তার ভিডিও করবে।’
গুই সাপটিকে পিটিয়ে হত্যা করলেন তিনি। শুধু তাই নয়, আনন্দ উল্লাসে সেই হত্যার খবর প্রকাশ করলেন নিজের ফেসবুকে। কিন্তু মুহূর্তেই সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে গেল সারাদেশে। প্রাণী প্রেমীরা প্রতিবাদ শুরু করলেন। অনেকের মতো পরিবেশ সাংবাদিক হোসেন সোহেলও এই হত্যার বিচার চাইলেন। এই বিষয়ে কথা বললেন কারিমা পুষ্পিতার সঙ্গে।
গুই সাপের বিবরণ শুনে পুষ্পিতা চোখের পানি আর আটকাতে পারেননি। কারণ ঘটনার বিবরণে তিনি বুঝতে পারেন, যে সাপটি তিনি মেরেছেন সেটি স্ত্রী লিঙ্গের ছিল। তার সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চা আছে। মাকে মেরে ফেলার কারণে হয়ত তার বাচ্চারাও খাবারের অভাবে মারা যাবে। কারণ সাপটির গলার কাছে ফোলা ছিল, যেখানে খাবার সংগ্রহ করে সে বাচ্চাদের জন্য নিয়ে যেত।
এরপর ফেসবুকে ফের স্ট্যাটাস দেন পুষ্পিতা। তার অপরাধের জন্য মাফ চান। আর কখনও তিনি এমন করবেন না বলেও ঘোষণা দেন।
কারিমা পুষ্পিতা নরসিংদীর পলাশ থানার দক্ষিণ দেওয়ার গ্রামের মেয়ে। তিনি একজন মা, তার একটি ছেলে আছে।
এই ঘটনার পর থেকেই অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন তিনি। পুষ্পিতা এতটাই অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন যে প্রতিদিন নিজের খামারের মোরগ নিয়ে আশপাশে গুইসাপ খোঁজেন এই আশায় যে, হয়ত মায়ের অবর্তমানে বাবা সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেবে। কিন্তু সেই সাপের তো আর দেখা মেলে না।
এদিকে শান্তি মেলে না পুষ্পিতার মনে। বার বার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মাফ চাচ্ছেন। প্রাণীর সেবায় সারাজীবন কাজ করার প্রতিজ্ঞা করছেন।
সর্বশেষ লিখেছেন, ‘কিছুদিন আগে একটি গুইসাপ হত্যা করে আমি যে অন্যায় করেছিলাম তা থেকে বেরতে পারছি না কিছুতেই। তারওতো একটা পরিবার ছিল, সন্তান ছিল, যেই গুইসাপটাকে মেরে ফেলেছিলাম জানি না সেটা পুরুষ না নারী, তবে অনুমান করছি নারী, কারণ তার পেটটা অনেক বড় ছিল, বোধ করছি তার পেটে ডিম ছিল, শুনেছি গুইসাপ গলায় খাবার জমিয়ে রাখে তার সন্তাদের খাওয়াবে বলে, জানি না কতটা খাবার জমাতে পেরেছিল সে, হয়তো তার বাচ্চারা অভুক্ত ছিল খুব, তাদেরকে প্রমিজ করে এসেছিল, তোমাদের জন্যে খাবার নিয়ে তবেই ফিরব। কিন্তু তার আর ফেরা হলো না, এর আগেই আমি তাকে মেরে ফেললাম। কি নিষ্ঠুর আমি! কি নিষ্ঠুর!! এখন তাদের জন্য কী করতে পারি সেসব ভেবে ভেবেই দিশেহারা আমি... সোহেল ভাই (পরিবেশ সাংবাদিক হোসেন সোহেল) আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, মনে হচ্ছে এতদিন আমি অন্ধ ছিলাম, মানসিক প্রতিবন্ধীও...।’
পৃথিবীতে অনেক খুনি যেমন পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে উল্টো মানবতার পক্ষে কাজ করেছেন, পুষ্পিতার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। একটি বন্যপ্রাণী হত্যার পর পুষ্পিতা এখন এতটাই বদলে গেছেন যে, নিজের অবস্থান থেকে সোচ্চার হচ্ছেন প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায়। কাজ করছেন বন্যপ্রাণীর জীবন রক্ষায়। যেন হত্যাকারী থেকে তিনি এখন বন্যপ্রাণী প্রেমিক।
তার এই পরিবর্তন নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন পরিবেশ সাংবাদিক হোসেন সোহেল। তিনি জানান, ফেসবুকে গুইসাপ মারার ছবি দেখে তীব্র প্রতিবাদ করি। মেয়েটিকে তিরস্কার করি। পরে তার সঙ্গে যখন আমার কথা হয়, সে তার ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভুগছে। এখন সে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছে।
এফএ/এমএস