কবে বন্ধ হবে মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানোর সিলেটের কুপ্রথা?

রিপন দে
রিপন দে রিপন দে মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: ০২:৫২ পিএম, ১৩ মে ২০১৯

চার মাস আগে শামীম আহমদের সঙ্গে হেলেনা বেগমের (২০) বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রথম রমজান মাস এবার। সিলেটের ঐতিহ্য হিসেবে (১০ মে) হেলেনার বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানো হয়। কিন্তু সেই ইফতার সামগ্রী শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মনমতো হয়নি। আর সেটা নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের গালমন্দ শুনতে হয় হেলেনাকে। এরই জেরে শনিবার বিকেলে নিজ ঘরে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন হেলেনা।

সিলেটের জৈন্তাপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মো. মাইনুল জাকির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মরদেহে আত্মহত্যার আলামত মিলেছে।

একইভাবে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার তারিক আহমেদ রমজানের একমাস আগে ৮ লাখ টাকা খরচ করে একমাত্র বোনের বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র বোন তাই ধুমধামে বিয়ে দিতে গিয়ে ৫ লাখ টাকা ঋণ করে ফেলছেন। বিয়ের একমাস পর ঋণের চাপের মধ্যেই এসেছে রমজান। তাই সিলেটের ঐতিহ্য মেনে বোনের বাড়ি ইফতার সামগ্রী পাঠাতে হবে। কিন্তু হাতে এক টাকাও নেই। আগের ঋণ রয়ে গেছে তাই নতুন করে টাকা ধার দিচ্ছে না কেউ।

এদিকে ইফতার না পাঠালে বোনকে কথা শুনতে হবে, পাড়া প্রতিবেশীর কাছে বোনের সম্মান থাকবে না। তাই লোকলজ্জার ভয়ে বাধ্য হয়ে হালের শেষ গরুটি বিক্রি করেন ৭০ হাজার টাকায়। সেই টাকা দিয়ে ইফতার সামগ্রী নিয়ে যান। বোনের বাড়িতে প্রচুর মানুষ দাওয়াত দেয়া হয়েছে। ফলে ৭০ হাজার টাকার ইফতারে সবার হয়নি। কেউ কিছু না বললেও লজ্জা পান মনে মনে।

তবে বোন জামাই বলেছেন, তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বেশি। তাই আগামী বছর একটু চেষ্টা করবেন।

সিলেটে ইফতার প্রথা পুরাতন এক ঐতিহ্য। বাবার বাড়ি থেকে রমজানে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানো হয়। সেই ইফতার শুধু মেয়ের বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত দেয়া হয় এবং সেইসঙ্গে একটি নীরব প্রতিযোগিতা চলে কার শ্বশুরবাড়ি থেকে কত বেশি আইটেমের ইফতার এলো, কে তার শ্বশুরবাড়ির ইফতার কয়শ মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াল।

যার শ্বশুরবাড়ি থেকে যত বেশি ইফতার আসে তার ততো সুনাম। তেমনি যে মেয়ের বাবার সে সক্ষমতা কম তিনি ইফতার দিয়ে খুশি করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে সেজন্য কথা শুনতে হয় মেয়েকে।

হয়তো মেয়েটি জানে তার বাবার অবস্থা তবুও শ্বশুরবাড়িতে নিজের সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে অনেক সময় ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়েই বাবাকে অনুরোধ করে। মেয়ের আবদার ফেলতে পারেন না বাবা। যেভাবেই হোক টাকা সংগ্রহ করেন।

তবে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এ এক ভীতিকর সামাজিক নিয়ম। সামাজিকতার এই নিইয়মের চাহিদা মেটাতে কেউ সুদে টাকা নেন, কেউ গরু বিক্রি করেন কেউবা নিজের চিকিৎসার টাকা দিয়ে ইফতার সামগ্রী কিনে মেয়ের বাড়িতে পাঠান। শুধু মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে।

তবে এই প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার বর্তমান প্রজন্ম। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সমাজকর্মী আব্দুল কায়ুম জানান, এই প্রথায় একজনের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, আমার চোখের সামনে অনেকে সুদে টাকা এনে, কেউ নিজের জমি বিক্রি করেও ইফতার পাঠান। আমি বিয়ে করেছি ৬ বছর কিন্তু আজ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি থেকে ইফতার নেইনি।

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় সামাজিক আন্দোলনের নেতা আব্দুল করিম কিম জানান, এই প্রথা থেকে বর্তমান সময়ে অনেকেই বের হয়ে আসছেন। রমজানে মেয়ের বাড়িতে ইফতার দেয়াটা অবস্থাপন্ন পরিবারের জন্য বিত্তের প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। তবে দরিদ্র মা-বাবাকে এই প্রথা পালন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হতে হয়। তাই মেয়ের বাড়িতে ইফতার নয় বরং মেয়ের নিজের হাতে রান্না করা খাবার মা-বাবার জন্য পাঠানোর সংস্কৃতি শুরু করা উচিত।

এমন প্রথা ইসলামে নেই জানিয়ে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশনের মহা-পরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল জাগো নিউজকে জানান, ইসলামে এমন কোনো বিধান নেই, সংযমের মাসে কারো উপর জোর করে ইফতারের আয়োজন চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। যার যা সামর্থ আছে তা দিয়েই ইফতার করবে।

এফএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।