এখনো নুসরাতের স্মৃতি খুঁজে বেড়ান স্বজন-সহপাঠিরা
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ফেনী
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ১০ মে ২০১৯
ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির স্মৃতি এখনো খুঁজে বেড়ান তার পরিবার, স্বজন ও শিক্ষক-সহপাঠীরা। তারা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না নুসরাতকে। হত্যাকাণ্ডের এক মাস পূর্ণ হলেও নুসরাত নেই এমনটি ভাবতে পারছেন না কেউই।
বৃহস্পতিবার সকালে নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শুনসান নীরবতা। নুসরাতের বেশ কয়েকজন সহপাঠী ও আশপাশের বেশ কয়েকজন নারী তাদের ঘরের ভেতরের অংশে। সেখান থেকে মৃদু কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার মেয়ের কাথা স্মরণ করে কান্না করছেন। নুসরাতের রুমে টেবিলে সাজানো বই-পত্র। বাবা বাড়িতে নেই। বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বৃহস্পতিবার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সোনাগাজীর বক্তার মুন্সি শাখায় যোগদান করেছেন।
কথা হয় নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বোন নুসরাত ছাড়া আমাদের পরিবার শুন্য। আমাদের ঘরে অনেক সম্পদ না থাকলেও আমাদের বোন সে ঘর আলোকিত করে রাখতো। বোনের স্মৃতির কথা মনে পড়লে রাতে ঘুম আসে না। আমার সঙ্গে কতইনা দুষ্টুমি করতো বোন আমার।
রায়হান আরও জানায়, তার মা এখনো বোনের (নুসরাত) জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসান। বাবা একেএম মূসার বোবা কান্না দেখে বুকটা ফেটে যায়।
এদিকে পরীক্ষা না থাকায় মাদরাসায় গিয়ে নুসরাতের কোনো সহপাঠীকে পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে উপস্থিত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অত্যন্ত শান্ত-স্বভাবের ছিল নুসরাত জাহান রাফি। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রায় মাদরাসায় আসা যাওয়া করতো সে। তার আচার-ব্যবহারে কোনো ধরণের ত্রুটি পাওয়া যেত না।
নুসরাতের খুব কাছের বন্ধু নিশাত, ফূর্তি, সাথী ও তামান্না। নিশাত ও ফূর্তির সঙ্গে নুসরারেত হাজারো স্মৃতি। তাদের বাড়িতে নিয়ে অপ্যায়ন করানোসহ মাদরাসার যতসব খুনসুঁটি তাদের সঙ্গে। নুসরাত তার সব কিছুই শেয়ার করতেন তাদের সঙ্গে। অধ্যক্ষের হাতে যৌন নিপীড়নের পর নিশাত ও ফূর্তি সঙ্গে থাকলেও সাথী-তামান্না ছিলো না। তাদের চিঠির মাধ্যমে অধ্যক্ষের কুকর্মের কথা জানিয়েছেন নুসরাত।
মুঠোফোনে নিশাত ও ফূর্তি বলেন, আমাদের খুব কাছের বান্ধবী নুসরাত। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি যা এখনো অমলিন। দেখা হলেই আমাদের নাম না বলে ‘আই লাভ ইউ’ বলে সম্বোধন করতো। আর কোনো কারণে দু-একদিন মাদরাসায় না আসলে ‘আই মিস ইউ’ বলে জড়িয়ে ধরতো নুসরাত।
তারা আরও বলেন, নুসরাত শিক্ষা দিয়ে গেছে কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন অসংখ্য নুসরাত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এখনো অসংখ্য সিরাজ স্কুল-মাদরাসায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। নুসরাতের খুনিদের বিচারের মাধ্যমে নুসরাতরা কিছুটা হলেও মুক্তিপাবে।
নুসরাতের দুই সহপাঠী মোশাররফ হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন নুসরাতকে। তারা জানান, ছেলেদের সঙ্গে না মিশলেও প্রায় সব মেয়ের সঙ্গেই নুসরাতের বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক ছিল।
মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মো. হোসাইন বলেন, নুসরাতকে এর আগে দেখেছি কি-না মনে পড়ছে না। তবে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে তাকে দেখতে যাই। এমন একটি নিষ্পাপ মেয়ের ওপর কীভাবে এমন নৃশংসতা চালিয়েছে ভাবতেই শিউরে উঠি। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করেন তিনি।
ফেনীর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, নুসরাত হত্যার ক্লু অল্প সময়ের মধ্যে উদঘটিত হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে শতভাগ আসামি গ্রেফতার হয়েছে। আদালতে ১২ আসামি জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য আসামিদের জবানবন্দি নেয়ার কাজ চলেছে। চলতি মাসের মধ্যেই অভিযোগপত্র দাখিল করা সম্ভব বলে আমরা আশাবাদী।
আলোচিত এ হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও পিবিআই। এদের মধ্যে ওই অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা, কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহমেদ, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, মো. শামীম, কামরুন নাহার মনি, আবদুর রহিম ওরফে শরিফ, ইফতেখার হোসেন রানা, এমরান হোসেন মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল, হাফেজ আবদুল কাদের ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ওই মাদরাসার সহ-সভাপতি রুহুল আমিন।
এ মামলায় মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১২ জন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন- নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের, জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল।
উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়ের দায়ে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।
রাশেদুল হাসান/আরএআর/এমএস