আয় নেই, তবুও ডুপ্লেক্স বাড়ি বানালেন যুবলীগ নেতা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৯

নিজের কোনো ব্যবসা নেই। বছরের পর বছর বেকার। এরপরও কোটি টাকা ব্যয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়েছেন কক্সবাজারের টেকনাফের উপকূলীয় বাহারছড়া শামলাপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন খোকন।

ইউনিয়নের পুরানপাড়া এলাকায় তার নির্মাণাধীন বাড়িটি সবার চোখ পড়েছে। তার বাড়িটি দেখে প্রশান্তি পেলেও এটি তৈরির অর্থের উৎস নিয়ে চোখ কপালে উঠেছে প্রতিবেশীদের।

লোকমুখে তথ্যটি প্রকাশ হওয়ার পর যুবলীগ সাধারণ সম্পাদকের আয়ের উৎস খুঁজতে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে টাকার উৎস সম্পর্কে রোমহর্ষক তথ্যও পেয়েছে তদন্ত দল।

তাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বেকার এই যুবলীগ নেতা পুরো ইউনিয়নে গড়ে তুলেছেন ইয়াবার সাম্রাজ্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়াতে মোটা অংকে কৌশলে ভাগিয়ে নিয়েছেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মাদক ব্যবসা থেকে যুব সমাজকে রক্ষায় ২০১৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা মাদক কারবারিদের একটি তালিকা তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দিয়েছিলেন। ওই তালিকায় ইয়াবা ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে যুবলীগ সম্পাদক খোকনের নাম রয়েছে ৪ নম্বরে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো রেজুলেশনে বলা হয়েছে, জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইউনিয়ন পর্যায়ের চোরাকারবারি, ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের কারণে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। তদন্তপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

ওই তালিকা ধরে তদন্তপূর্বক এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ওসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত খোকনসহ তালিকায় থাকা কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। তবে তালিকার র্শীষে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ী হাবিব উল্লাহ প্রকাশ হাবা চৌধুরী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন গত বছর। হাবিব উল্লাহ নিহত হওয়ার পর খোকনসহ অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর আবার এলাকায় ফিরে এসে নতুন উদ্যমে ইয়াবা ব্যবসা চালাচ্ছেন খোকন।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, খোকন নিজেকে জমি ব্যবসায়ী দাবি করলেও দৃশত তার কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। মূলত ইয়াবা ব্যবসা আড়াল করতেই এমন প্রচারণা চালান তিনি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, খোকন বেকার যুবক। সকালে ঘুম থেকে ওঠে শামলাপুর বাজারে যুবলীগ কর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান তিনি। মাঝেমধ্যে টেকনাফ উপজেলায় যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ নেতা এরশাদুর হক এশা মেম্বারের নাতি খোকন ও তার পরিবার এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দলের প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত তারা।

এলাকাবাসীর দেয়া তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসে শামলাপুর পুরানপাড়া ঘাটে। এখান থেকে খোকনের সহযোগীরা ইয়াবার চালান নিয়ে গোপন স্থানে জমান। পরে সুবিধা মতো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে দেন।

বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় ইউনিয়ন ও উপজেলাভিত্তিক মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা প্রণয়নের জন্য জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশ মতে, ২০১৩ সালের ২০ অক্টোবর টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মৌলভী হাবিব উল্লাহর সভাপতিত্বে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ইউনিয়নপর্যায়ে মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি ও ইয়াবা ব্যবসায়ী ১০ জনের তালিকা করা হয়। ওই তালিকার ৪ নম্বরে রয়েছেন আমাজাদ হোসেন খোকন। তিনি শামলাপুর পুরানপাড়া এলাকার মো. ইসলাম ওরফে ইসলাম মেম্বারের ছেলে।

ওই তালিকায় শীর্ষে থাকা নয়াপাড়া এলাকার হাবিব উল্লাহ প্রকাশ হাবা চৌধুরী ২০১৮ সালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। এছাড়া তালিকায় রয়েছেন পুরানপাড়ার মৃত এরশাদুল হকের ছেলে আজিজুল হক প্রকাশ আয়াছ কোম্পানি, শাপলাপুর বাজারের আক্তার ফার্মেসির মালিক মো. আক্তার, পুরানপাড়া এলাকার ডা. নজরুলের ছেলে মো. আরিফ, একই এলাকার মীর কাশেমের ছেলে মো. ইলিয়াছসহ ১০ জন।

সাবেক চেয়ারম্যান মৌলভী হাবিব উল্লাহ বলেন, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা একটি তালিকা করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল। তবে পরবর্তীতে আর কি হয়েছে আমি জানি না।

ইয়াবার অভিযোগ ছাড়াও খোকনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যু, মারামারি, হত্যার হুমকিসহ নানা অভিযোগে অনেক ভুক্তভোগী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। ২০১৩ সালের ২১ জুলাই অছি আহমদ (টেকনাফ থানা জিডি নং-৯৩৩), ২০০৯ সালের ২ ডিসেম্বর মোর্শেদ আলী (৫৭), ২০১০ সালে ৩ মে শামসুল আলম (১১৫), ২০১১ সালের ১২ মে জাহেদুল ইসলামসহ (৫৮২), ২০১০ সালে (৩০) আরও বেশ কয়েকজন থানায় অভিযোগ দেন।

কিন্তু এলাকায় প্রভাব থাকায় খোকনকে ছুঁতে পারে না কেউ। আবার দলের যেকোনো প্রোগ্রামে ডোনার হিসেবে আবির্ভাব হন বলেই নিরাপদে রয়েছেন আমজাদ হোসেন খোকন।

আমজাদ হোসেন খোকন তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আগে দৃশ্যমান কোনো কাজ না করলেও বছর তিনেক আগ থেকে জমি কেনাবেচা, ফিশিং ট্রলার ব্যবসাসহ হোটলে কক্স টু ডে কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠান সুইট ড্রিম কোম্পানিতে চাকরি করছি আমি। কোটি টাকার বাড়িটি শামলাপুর বাজারে বাবার জমি বিক্রির ২৫ লাখ টাকা, দুবাই প্রবাসী ভাইদের পাঠানো টাকা ও কক্সবাজার শহরে হাজিপাড়ায় বেশ কিছুদিন আগে কম দামে কেনা একটি জমি অধিক মূল্যে বিক্রির টাকায় করেছি। আমার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ পূর্বশত্রুতার বহিঃপ্রকাশ।

বেকার জীবনে কক্সবাজার শহরে জমি কেনা, সাগরে ফিশিং ট্রলার নামানোসহ অন্যান্য ব্যবসার পুঁজি কোথায় থেকে পেলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাবার দুই পরিবার থাকায় অল্প-স্বল্প পুঁজি দিয়েছেন আমাকে।

তার হিসাবমতে, সবমিলিয়ে এখন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তার। এসবের বিপরীতে আয়কর সনদসহ অন্য কোনো কাগজপত্র রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অসচেতনতার কারণে এসব করা হয়নি। এলাকার অনেকের এসব কাগজপত্র নেই। তাই আমিও এসব করার প্রয়োজন অনুভব করিনি।

টেকনাফ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, আমরা পুরো টেকনাফের মাদক কারবারিদের নির্মূলে কাজ করছি। উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোর প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেউ ছাড় পাবে না, সেভাবেই নির্দেশ রয়েছে ওপর মহলের। পর্যায়ক্রমে সবাই ধরা পড়বে।

সায়ীদ আলমগীর/এএম/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।