নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত রুহুল আমিনের উত্থানের নেপথ্যে
ফেনীর সোনাগাজীর বিতর্কিত আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনের অপরাধের শেষ নেই।
গত শুক্রবার পিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে চলছে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা। শনিবার তাকে আদালতে হাজির করে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পেছনে অন্যতম কারিগর এ রুহুল আমিন। একসময় পেটের তাগিদে সৌদি আরব চলে যান। সেখানে ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। কোনোরকমে চলতো সংসার।
জাতীয় পার্টির হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হলেও অল্পদিনে উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে চলে আসেন রুহুল আমিন। বালুমহাল লুটসহ বহু অপরাধে জড়িত তিনি। অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। বালুমহাল সবসময় পাহারা দিচ্ছে তার ক্যাডার বাহিনী। নিজ দলের নেতাকর্মীরাও তার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সোনাগাজীর বিভিন্ন স্তরের দলীয় নেতা, মাদরাসার একাধিক শিক্ষক-অভিভাবক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
রুহুল আমিনের প্রতিবেশীরা জানান, সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উচিয়াঘোনা কেরানী বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন। পড়াশোনা করেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। বড় ভাই আবুল কাশেম যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তিনি সেখানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আরেক ভাই আবু সুফিয়ানও যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির রাজনীতি করেন।
দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন রুহুল আমিন। একই বছর উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল কবিরের হাতে সোনাগাজী ফরিদ সুপার মার্কেটের সামনের এক সমাবেশে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু কখনো দলে সক্রিয় ছিলেন না তিনি।
২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবে অবস্থান করেন। সেখানে ট্যাক্সি চালান। এরপর ২০০৯ সালের পর তিনি বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে গোপনে সম্পৃক্ত হন। প্রায় তিন বছর পরে হঠাৎ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন রুহুল আমিন। এ সময় দলের অন্য নেতারা এর ঘোর বিরোধিতা করেন। অনেক তদবির করে অবশেষে ২০১৩ সালে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সদস্য হন। এরপর ২০১৬ সালে নিজাম হাজারী এমপির আশীর্বাদে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৫ সালে হঠাৎ সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। তখন থেকেই সোনাগাজীতে নানা অপকর্ম শুরু করেন রুহুল আমিন। ২০১৮ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় তাকে প্রথমে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে তাকে সভাপতি করা হয়। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রুহুল আমিন। গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।
এসময় ছোট ফেনী নদীর মুহুরী প্রকল্প অংশের একটি বালুমহাল ও ছোট ফেনী নদীর সাহেবের ঘাট এলাকায় আরেকটি বড় বালুমহাল সাবেক এমপি রহিম উল্যাহর লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর রুহুল ও তার ক্যাডার বাহিনী এই দুটি বালুমহালের দখল নেন। এখনো দুটি বালুমহালে কয়েক কোটি টাকার বালু রয়েছে বলে জানায় স্থানীয়রা। প্রতিদিন তার ক্যাডাররা এসব পাহারা দিচ্ছে।
দলের একাধিক সূত্র জানায়, সোনাগাজী থানায় সালিশ ও তদবির বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রুহুল আমিনের ক্যাডাররা। আওয়ামী লীগের নেতা হলেও বিএনপি-যুবদলের ক্যাডারদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। এদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি নেতা খুরশিদ আলম, রুহুলের চাচাতো ভাই চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াধন ও তার ২০-২৫ জনের ক্যাডার বাহিনী।
তার বাহিনীতে আরও রয়েছেন ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার দুলাল ওরফে বাটা দুলাল, ইয়াবা বিক্রেতা হেলাল, সিরাজ ওরফে সিরাজ ডাকাত, আবুল কাশেম ওরফে কাশেম মাঝি, সাবমিয়া, ফকির বাড়ির গোলাপ, আব্দুল হালিম ও সোহেলসহ বেশ কয়েকজন। এদের হাতে বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী।
এমনকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য আবুল কালাম বাহারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তার ক্যাডাররা। সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা স্বপন, চরদরবেশ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ, মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটনসহ অনেকে বিভিন্ন সময় রুহুল আমিনের বাহিনীর হাতে মারধরের শিকার হন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা হওয়া সত্ত্বেও রুহুলের অনুগত না হওয়ায় সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাধরণ সম্পাদক নুরুল আবসার, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপতথ্য সম্পাদক আব্দুর রহিম খোকনসহ বেশ কয়েকজনকে পদ থেকে বাদ দেয়া হয়। এদের অনেকে এখন দলে নিষ্ক্রিয়।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসার একাধিক সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সোনাগাজী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মামুন ওই মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ৬-৭ মাস আগে নানা কৌশলে শেখ মামুনকে বাদ দিয়ে রুহুল আমিন সদস্য মনোনীত হন। এক্ষেত্রে সিরাজের নানা অপকর্ম ধামাচাপা এবং নিজর প্রভাব বাড়াতে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজই তাকে সদস্য হওয়ার সুযোগ করে দেন।
এর কিছুদিনের মধ্যেই রুহুল সহ-সভাপতি হয়ে যান। মাদরাসার মার্কেটের ১২টি দোকান, ভেতরের বিশাল পুকুরের মাছ চাষ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপায়ে আদায় করা বাড়তি টাকার ভাগ পেতেন রুহুল আমিন ও আরেক সদস্য কাউন্সিলর মাকসুদ। ক্যাম্পাসের বাইরে মাদরাসার রয়েছে জমিসহ কোটি টাকার সম্পদ।
মাদরাসার একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ প্রায়ই বলতেন, ‘রুহুল, মাকসুদ এরা সবাই অশিক্ষিত। এদের সুবিধা দিয়ে আমাদের পক্ষে রাখতে হবে। এরা থাকলে দুইরকম সুবিধা। একদিকে এরা কোনো বিষয়ে উচ্চবাচ্য করবে না। আবার সবসময় আমাদের পক্ষেও থাকবে।’
জানা যায়, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার নানা দুর্নীতি ছাড়াও জমি দখল, পদবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও অবৈধ বালু উত্তোলনসহ অসংখ্য অপরাধে জড়িত রুহুল আমিন ও তার ক্যাডার বাহিনী। অবৈধ বালু উত্তোলনে বাধা দেয়ায় ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসির বিরুদ্ধে মামলা করেন রুহুল আমিন। পরবর্তীতে মামলা প্রত্যাহার করেন। দলের প্রভাব খাটিয়ে পদ বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। একইভাবে সোনাগাজী উপজেলার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। দলের প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার চরচান্দিায়া পূর্ব বড়ধলি মৌজায় শতাধিক ভূমহীনদের জমি দখল করেন রুহুল আমিন।
দলীয় সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফয়েজ কবির স্বপদে বহাল থাকা অবস্থায় রুহুল আমিন কীভাবে সভাপতি হলেন তা অনেকেই জানেন না। ফয়েজ কবির উপজেলা সভাপতি হিসেবে ফেনী জেলা পরিষদে প্রথমে সদস্য ও পরে প্যানেল চেয়ারম্যান হন।
ফয়েজ কবির বলেন, ‘আমি আমার পদ থেকে পদত্যাগ করিনি, আবার আমাকে বাদও দেয়া হয়নি। তাহলে অন্য কেউ কীভাবে এ পদের পরিচয় দিতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। রুহুল আমিন কীভাবে সভাপতি হলেন আমি জানি না। তবে এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।’
এ বিষয়ে সাবেক এমপি রহিম উল্যাহ বলেন, ‘আমি ও ডাক্তার গোলাম মাওলা সোনাগাজী শহীদ ছাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু সোনাগাজী বাজারের পশ্চিমাংশের একটি পক্ষ হঠাৎ করে রুহুল আমিনকে সেখানে নিয়ে যায়। পরে অভিভাবক সদস্যসহ কয়েকজন সদস্যকে চাপ প্রয়োগ করে তাকে সভাপতি করতে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান রুহুলকে সভাপতি মনোনীত করলেও আমি আর সভাপতির চেয়ারে বসতে পারিনি। রুহুল আমিন ও তার লোকজন দফায় দফায় আমার ওপর হামলা চালায়।’
এএম/এমএস