ফেনীতে অপরাধের শেষ নেই, অসংখ্য পতিতালয় আছে
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ফেনী
প্রকাশিত: ০৬:২১ পিএম, ১৩ এপ্রিল ২০১৯
ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে (১৮) অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের পর কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন তৎকালীন সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে ‘নাটক’ ও পরবর্তীতে অগ্নিদগ্ধের ঘটনাকে ‘আত্মহত্যার’ রূপ দিতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম।
দুটি ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ তার সহযোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন মোয়াজ্জেম। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগে ১০ এপ্রিল বুধবার সোনাগাজী মডেল থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
এরই মধ্যে ফেনীতে হওয়া বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন জেলার সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। তার স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
সোহেল রানা লিখেছেন, ‘আপনারা সবই জানেন, তাও বলি, সত্য সূর্যের মতই। দিন-দুপুরে ছিনতাই হয়েছে বিজয়সিং দিঘীতে। ছিনতাইয়ের শিকার যুবকের করা মামলা নেয়নি ওসি রাশেদ চৌধুরী। মামলা নিতে চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছে। তারপরও নেয়নি মামলা। এরপর অন্তত ১০টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আমি থানায় পাঠিয়েছি ভিকটিমদের। ওসি মামলা নেয়নি। জিডি করতে বাধ্য হয়েছে ভিকটিমরা। আমার জিজ্ঞাসা কেন মামলা নেয়নি ওসি? ছিনতাইয়ের কি জিডি হয়? ফেনীতে দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে জায়গা দখল করেছে এক কাউন্সিলর, অন্যখানে আর একজন প্রভাবশালী নেতা। তাকে জায়গা দখলে সুরক্ষা দিয়েছে স্বয়ং সদর থানার ওসি। আমি বাধা দিতে চেয়েছি, আমাকে থামানো হয়েছে। কে থামাতে চেয়েছে সেটা আর না-ই বললাম। ফেনী শহরজুড়ে অনেকগুলো পতিতালয় আছে। যেখানে মানুষকে নিয়ে ভিকটিম বানিয়ে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে টাকা উদ্ধার করা হয়। এরকম ঘটনা আমার কাছে এসেছে অসংখ্য।’
সোহেল রানা আরও লিখেছেন, ‘এসব পতিতালয়ের নিয়ন্ত্রক কারা? প্রকাশ্যে জনিকে অস্ত্রসহ ধরার পর পুলিশকে আসতে বলি স্পটে। সেখানে পুলিশ আসে এবং আমাকে সাহায্য করে। আমি পুলিশকে অস্ত্র আইনে মামলা করতে বলি, পুলিশ মামলা করতে অপারগতা জানায়। কেন? আমাকে পুলিশ এও বলে যে, আমি ধরেছি আমাকেই মামলা করতে হবে। অথচ পুলিশ আমার সঙ্গে ছিল। হাস্যকর না। ফেনীর এক চেয়ারম্যান আমাকে চোরাচালানের তথ্য দেয়ার জন্য রাজনৈতিক বড় নেতা থেকে শুরু করে সিন্ডিকেটের সবাই তাকে শাসিয়েছে। ডিবির এএসপি আমিনুল তাকে বলেছে সে কীভাবে নির্বাচন করে সেটা সে দেখে নেবে। ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিজমির মাটি কাটা নিয়ে শুরু করে, মাদক, স্বর্ণ চোরাচালান প্রায় প্রতিটি বিষয়ে যতটা না অপরাধীদের সঙ্গে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে। ফেনীর বালুমহাল নিয়ন্ত্রকদের শাস্তি প্রদানে কাজ করতে পারিনি আমি।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘একটা বছর ধরে পুরো সিন্ডিকেট মিলে আমাকে পদে পদে বাধা দিয়েছে। নির্বাচনে আমার গাড়ি থেকে প্রটেকশন উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। সারারাত জেগে আমার পরিবারকে পাহারা দিতে হয়েছে। এ শহরের প্রতিটি ইঞ্চি আমি চিনি। শহরের প্রতিটি ইটের ভাষাও আমি জানি। সংগ্রামটা অবিশ্বাস্য হলেও শুধু আমার একারই ছিল, আমি ভয়ানক একাই ছিলাম। শুধু আমার দু-একজন বস আর ফেনীর সাধারণ মানুষ ছিল সঙ্গে। তাদের কারণে এক ইঞ্চি মাঠও ছাড়ি নাই। তবে অনেক সময়ই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারিনি, থামিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্য নিজেকে প্রায়ই অপরাধী মনে হয়। পুরো প্রশাসন হয় উদাসীন, নয় অপরাধের সঙ্গে জড়িত, সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, অন্যায়ের সঙ্গে, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। ঔদাসীন্যও এক ধরনের অপরাধ। এদের মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনলে আমার থুতু দিতে ইচ্ছে হতো। এগুলো কিছুই সাংবাদিকরা লেখেনি। আমি লিখতে বলেছি, এরা ভয়ে লেখে নাই। রয়েছে এমন শত শত ঘটনা।’
সোহেল রানা আরও লিখেছেন, ‘এসব ঘটনা বলার কারণ, এগুলো অন্যায়, ভয়াবহ অন্যায়। এই সমাজ এই অন্যায়গুলোর ধারক ও বাহক। এদের কাছে আপনি কীভাবে নুসরাত হত্যার বিচার পাবেন? স্বেচ্ছায় বিদেশে এসেছি পড়তে, দেশে ফিরব পড়াশোনা শেষে। সরকার চাইলে কাজ করব, না হলে চাকরি ছেড়ে দেব। প্রত্যয় এটুকুই- যুদ্ধের জীবন চলছে, চলবে।’
এএম/এমএস