স্ত্রীর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত পলান সরকার
স্ত্রী রাহেলা বিবির কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন একুশে পদক প্রাপ্ত ‘বইপ্রেমী’ পলান সরকার। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
এর আগে সকালে নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজশাহীর বাঘার বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিথর দেহে শেষবারের মত যান পলান সরকার। সেখানেই তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় ইমামতি করেন বাঘার বাউসা পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ আবুল বাশার। পরে নিজ হাতে গড়া পাঠাগারের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
পলান সরকারের জানাজায় অংশ নেন - রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের, পুলিশ সুপার মো. শহীদুল্লাহ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীন রেজা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, সরের হাট এতিমখানার পরিচালক সাদা মনের মানুষ শামসুদ্দিন সরকার, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদ্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাবলু, বাঘা পৌরসভার মেয়র আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মেয়র আক্কাস আলী, বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, বাঘার বাউসা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম প্রমুখ। এছাড়াও জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেন।
এর আগে গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে বাউসায় নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পলান সরকার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। পলান সরকার বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পলান সরকারের স্ত্রী রাহেলা বেগম (৮৫) মারা যান।
বাউসা বাজার গেদুর মোড়ে পলান সরকারের বাড়ি। বাড়ির পাশেই গড়ে তুলেছেন পাঠাগার। এখন সেখান থেকে ছড়িয়ে যায় জ্ঞানের আলো। ১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার। তবে মা ‘পলান’ নামে ডাকতেন। পাঁচ বছর বয়সে বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারকে হারান পলান।
এরপর আর্থিক সংকটে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় চতুর্থ শ্রেণিতেই। পরে নানা ময়েন উদ্দিন সরকার মা মইফুন নেসাসহ পলান সরকারকে নিয়ে আসেন নিজ বাড়ি বাউসায়। সেখানকার স্কুলে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির পর ইতি টানেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। তবে বই পড়ার অভ্যাস থেকেই যায়। প্রথমে এরওর কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়তেন। যখন যে বই পেয়েছেন সাগ্রহে পড়েছেন।
পলান সরকার বড় হন নানা বাড়িতে। নানা ময়েজ উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। যৌবনে তিনি নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারির চাকরি পান তিনি। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তিরও মালিক হন।
ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। অভিনয় করতেন ভাঁড়ের চরিত্রে। হাসাতেন লোক। আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপও বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে তার।
১৯৬৫ সালে ৫২ শতাংশ জমি দান করে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন পলান সরকার। ১৯৯০ সাল থেকে বাউসা ওই বিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের বই উপহার দিতেন তিনি।
এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও বইয়ের আবদার করলে সিদ্ধান্ত নেন তাদেরও বই দেবেন। শর্ত দেন পড়ার পর তা ফেরত দেয়ার। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করেন। ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বই পড়া আন্দোলন।
১৯৯২ সালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হন পলান সরকার। ওই সময় তিনি হাঁটার অভ্যাস করেন। এ থেকেই বিদ্যালয় কেন্দ্রিক বই বিতরণ প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া শুরু করেন। পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হয়ে।
পড়তে দেয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি লেখকদের বইগুলো রয়েছে পলান সরকারের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায়। তাছাড়া লোক সাহিত্যসহ অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের বইও তিনি বিতরণ করেন।
এভাবেই চা দোকানি থেকে শুরু করে গৃহবধূ সবাই তার পাঠকের তালিকায় চলে আসেন। বদলে যায় দৃশ্যপট। নিজের গ্রামে তার বাড়িটিই হয়ে ওঠে পাঠাগার। তবে ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। দান-অনুদানে মিলে যায় বইসহ অন্যান্য আসবাব।
প্রথমে আশেপাশের দশগ্রামের মানুষই কেবল জানতেন পলান সরকারের কীর্তি। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তাকে তুলে আনে আলোকিত মানুষ হিসেবে। এরপর তিনি ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন।
২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয় নাটক, বিজ্ঞাপন চিত্র। শিক্ষা বিস্তারের অনন্য আন্দোলন গড়ে তোলায় ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে সাদা মনের মানুষ খেতাবে ভূষিত করে।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর/এমএস