স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা-তদবির করে আজ আমি ক্লান্ত

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি সুনামগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৭:২৪ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দেশকে স্বাধীন করতে স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই বীরত্বগাঁথা সংগ্রামে ইতিহাস যেমন জাতিকে গর্বিত করে তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বঞ্চনা আর যথাযথ সম্মান না পাওয়ার বিষয়টি ব্যথিতও করে।

তেমনি স্বীকৃতি ও সম্মান না পাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধার নাম তাইবুর রহমান। বাড়ি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের বীরগাঁও গ্রামে। তিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫নং সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন হেলাল সেলা সাবসেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার খুরশেদ আলমের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাইবুর রহমান কর্নেল এমএজি ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদপত্র লাভ করেন।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের তালিকায় নাম উঠে আসে তার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ে সাক্ষাৎকার না দেয়ায় তাইবুর রহমানের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়।

দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক চেষ্টা করেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ হয়নি তার। নাম অন্তর্ভুক্তি না হওয়ায় তাইবুর রহমান বঞ্চিত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে।

প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও তালিকায় নাম না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে পারছেন না তিনি। নিজ গ্রামের মানুষ তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে ডাকলেও কাগজে-কলমে তার স্বীকৃতি মিলেনি আজও। মৃত্যুর আগে তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পেতে চান, এটাই তার আশা। ৭৩ বছর বয়সী তাইবুর রহমান এখন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন।

তাইবুর রহমানের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধের দামামা বাজে তখন পাক হানাদারদের দখলে দেশের প্রতিটি অঞ্চল। হানাদাররা চালাচ্ছে নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ। দেশমাতৃকার টানে স্বজনদের অগোচরে পাক সৈন্যদের প্রতিহত করতে ভারতের শরণার্থী শিবিরে ছুটেছেন অসংখ্য তরুণ। তেমনি ২২ জন তরুণের দলে ৭১র আগস্টে যোগ দিয়েছিল পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের একটি দল।

তাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ২২ বছর বয়সী তরুণ তাইবুর রহমান। তিনি বীরগাঁও গ্রামের মৃত আব্দুল গফুরের তৃতীয় সন্তান। তাইবুর রহমান টেকেরঘাট হয়ে বালাট শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। শরণার্থী শিবিরে ২ রাত কাটানোর পর পাথরঘাট মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় স্থান ইয়ুথ ক্যাম্পে অবস্থান করেন। ক্যাম্পে ৫ দিন অবস্থানের পর গাড়ি করে শিলং ইকো ওয়ান ২৮-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সেলা সাবসেক্টর অধীন সেকশন কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন মিশনে এফএফ হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সুনামগঞ্জের ছাতক, বুগলাই, টেংরা, হাদাটিলা, বাঁশতলাসহ কয়েকটি স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ করেন তিনি। টেংরাটিলা সম্মুখ যুদ্ধে সঙ্গে থাকা ৬ জন শহীদ হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনিসহ বাকিরা।

যুদ্ধের কথা স্মরণ করলে এখনও গা শিউরে উঠে তার। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ২২ বছরের টগবগে যুবক এখন বয়সের ভারে চলতে পারেন না। কমেনি দেশপ্রেমিক যোদ্ধার যুদ্ধকালীন তেজ।

যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তাইবুর রহমান বলেন, আমি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছি। পাক হানাদারের বুলেটের ভয় করিনি। ৪৭ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পাইনি। অনেক চেষ্টা-তদবির করে আজ আমি ক্লান্ত। ভুগছি মরণব্যাধি রোগে। কবে অপারে চলে যাব তার ঠিক নেই। মরার আগে শুধু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাই।

এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার আতাউর রহমান বলেন, তাইবুর রহমানের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাই। তবে তার যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনেকের কাছ থেকে শুনেছি। নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য তিনি অনেকবার আমার কাছে এসেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হালনাগাদের বিষয়ে অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন তা বন্ধ আছে।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা বাছাই কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকলে স্বীকৃতি পাওয়াটা একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য অধিকার। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তি করতে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন গ্রহণ করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য আদালতে মামলা হওয়ায় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

তাইবুর রহমানের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাইবুর রহামানের ব্যাপারটি দুঃখজনক। নতুন করে অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হলে তিনি যদি নিয়মতান্ত্রিক আবেদন করেন তাহলে তালিকায় অন্তর্ভুক্তিতে আসতে পারবেন।

এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।