রাসিকের বর্জ্যে তৈরি হবে বিদ্যুৎ
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক)। এরই মধ্যে জ্বালানি উৎপাদনে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে রাসিক। বিদ্যুৎ তৈরিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চলছে আলোচনা।
নগর সংস্থা বলছে, পরিবেশসম্মত নগরী গড়তে চায় রাসিক। কিন্তু দিনে দিনে ভাগাড়ে জমছে বর্জ্যের পাহাড়। এখনই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় না গেলে সংকট আরও বাড়বে।
রাসিকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন নগরীতে গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২৪০ থেকে ৩০০ টন। এর প্রায় ১৫ শতাংশই ব্যবহার নিষিদ্ধ ও পরিবেশের জন্য হুমকি প্লাস্টিক এবং পলিথিন। দীর্ঘদিন ধরে অক্ষত থেকে এই প্লাস্টিক ও পলিথিন কৃষি এবং পরিবেশের মারাত্মক বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাইপাস সড়ক সংলগ্ন নগরীর সিটি পশুহাট এলাকায় রাসিকের ভাগাড়। ১৯৯৫ সালে ১২ একর আয়োতনের এই ভাগাড়ে বর্জ্য ডাম্পিং শুরু করে রাসিক। কোনো ধরনেরর শোধন ছাড়াই দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে বর্জ্য স্তূপ হচ্ছে এখানে। এতে মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছে পুরো এলাকায়।
নগর কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক না হওয়ায় ভাগাড়ে প্রতিদিনই বর্জ্যের পাহাড় জমেছে। এই পরিস্থিতিতে ভাগাড়ের পরিধি বাড়ানো জরুরি। তবে পুরো প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন হলে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে।
এ পরিকল্পনা থেকেই ‘কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাসিক। পরিকল্পিতভাবে কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ এবং নগরীর পরিবেশ উন্নয়ন নিশ্চিত করা এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পুরো সরকারি অর্থায়নে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু রাসিকের এই প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন পায়নি।
তবে থেমে নেই নগর কর্তৃপক্ষ। গত ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েস্ট টেকনোলজি এলএলসি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে রাসিক। একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি নগরীর বর্জ্যে থাকা পলিথিন ও প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাত করে ডিজেল ও এলপিজি গ্যাস তৈরি করবে। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে আড়াই বছর।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি রাসিকের ভাগাড় সংলগ্ন ৭ শতাংশ ভূমিতে নিজস্ব অর্থায়নে প্ল্যান্ট পরিচালনা করবে। তাতে বর্জ্য সরবরাহ করবে রাসিক। শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটি এই প্ল্যান্ট বসাবে বলে জানিয়েছে রাসিক।
এদিকে, প্লাস্টিক-পলিথিন বাদে বাকি ৮৫ শতাংশ বর্জ্য নিয়েও ভাবছে নগর কর্তৃপক্ষ। তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করছে রাসিক। বড় পরিসরে নেয়া এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে রাসিক ছাড়াও আশেপাশের সব পৌর এলাকার বর্জ্য চলে যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
অন্যদিকে, নগরীর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও বেহাল অবস্থা। এতে বাড়ছে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিষয়টি মাথায় রেখে মেডিকেল বর্জ্য শোধনে যাচ্ছে রাসিক। সর্বশেষ সোমবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) এ নিয়ে বেসরকারি সংস্থা প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে নগর কর্তৃপক্ষ।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সকল চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়কেন্দ্র থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করবে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্ল্যান্টে নিয়ে শোধন এবং অপসারণ করবে। স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো ছাড়াও পরিবেশ দূষণ রোধ করবে এই কার্যক্রম। অচিরেই এই কাজ শুরু হওয়ার কথা।
এ প্রসঙ্গে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, নগরীর বর্জ্য বস্থাপনার আধুনিকায়নে রাসিক যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে এমনই একটি প্রকল্প নিচ্ছে সরকার। ফলে আলাদা করে রাসিকের ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তবে নগরীর প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য অচিরেই প্রক্রিয়াজাত শুরু হচ্ছে। রাসিকের বাকি বর্জ্যসহ অন্যান্য পৌর এলাকার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আসবে।
ওয়েস্ট টেকনোলজি এলএলসি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. মঈন উদ্দিন সরকার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক বর্জ্য চরম হুমকি। কিন্তু এ বর্জ্য যথাযথ প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে দেশের সমৃদ্ধিতে কাজে লাগানো সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে এক লিটার ডিজেল উৎপাদনে ব্যয় হবে মাত্র ২৫ টাকা।
এই থেকে এলপিজি গ্যাস ও জেট ফুয়েল উৎপাদন সম্ভব। আমেরিকায় তাদের এমন একটি প্রকল্প রয়েছে। সেখানে প্রতিটন বর্জ্য থেকে ১৩০০ লিটার জ্বালানি তেল, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার জেট ফুয়েল তৈরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, পলিথিন পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য ক্ষতিকর। এই উদ্যোগ সফল হলে নগরী বর্জ্য মুক্ত হবে, পাওয়া যাবে জ্বালানি। পরিবেশসম্মত নগরীর যাত্রায় আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে রাসিক। স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে বাসযোগ্য নগরী গড়তে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। এখনই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় না গেলে সংকট আরও বাড়বে।
এএম/এমএস