ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ আজ, আড়ালেই গডফাদাররা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৯:০০ পিএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ উপলক্ষে নির্মিত মঞ্চ, উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

চলমান মাদকবিরোধী অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশে প্রথমবারের মতো মাদক ব্যবসায়ীদের একটি অংশ আজ শনিবার আত্মসমর্পণ করছে। দেশের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সকাল ১০টায় এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তবে বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন ইয়াবা সাম্রাজ্যের আলোচিত ব্যক্তিরা।

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শনিবারের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে প্রায় দেড়শ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করবেন। তাদের মধ্যে ৫৭ জনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি বলে দাবি প্রশাসনের। তবে একটি অংশ আত্মসমর্পণ করলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের গডফাদার এবং কারবারিদের বড় একটি অংশ।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন শুক্রবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শনিবার শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করবেন। তবে এ সংখ্যা একটু কমবেশি হতে পারে। এদের মধ্যে চিহ্নিত এবং তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছেন অর্ধশতাধিক।’

কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের সেফহোমে থাকা শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়াবা পাচার, অর্থ লেনদেনসহ নানা বিষয় নিয়ে তথ্য দিয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশ তা লিপিবদ্ধ করেছে। ওই তথ্য মতে, তাদের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি বলা হলেও নেপথ্যে একটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। যে চক্রের সদস্যদের কারও নাম ইতোমধ্যে প্রশাসন বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো তালিকায় আসেনি। তারা নেপথ্যে অবস্থান করে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনায় সহযোগিতা করে থাকেন।

সূত্র মতে, টেকনাফের কোনো ব্যক্তির ইয়াবা ব্যবসায় জড়াতে বিনিয়োগ লাগে না। মিয়ানমার থেকে বিনামূল্যে ইয়াবার চালান পাঠানো হয় টেকনাফের নির্ধারিত ব্যক্তির কাছে। পাঠানোর সময় তা কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জব্দ হলে তার মূল্য পরিশোধ করতে হয় না। যে চালান নিরাপদে ব্যক্তি বিশেষের কাছে পৌঁছায় কেবল তারই মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধ করতে হয় দেশের মধ্যে। মিয়ানমারে সরাসরি কোনো টাকা বা অর্থ পাঠাতে হয় না। দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত নির্ধারিত এজেন্টরা এ টাকা সংগ্রহ করে থাকেন।

ইতোমধ্যে আত্মসমর্পণে আসা ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিতে এমন ৩০ এজেন্টের নাম পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ টাকা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার করা হয় দুবাই ও সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত ইয়াবার মূল মালিকদের কাছে। আর দুবাই, সিঙ্গাপুর ঘুরে এ অর্থ পৌঁছায় মিয়ানমারে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মনে করেন, ইয়াবা গডফাদারদের নেপথ্যে রয়েছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। আর এসব হুন্ডি ব্যবসার নেপথ্যের ব্যক্তিরা রয়েছেন দুবাই এবং সিঙ্গাপুর।

Coxs-Teknaf-Pic-3

আত্মসমর্পণ করবেন বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুবাই, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া থেকেও মাদক ব্যবসায় জড়িত কিছু ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করতে দেশে ফিরেছেন। ফলে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নেপথ্যের ব্যক্তিদের শনাক্ত করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

সূত্র মতে, ইতোমধ্যে ইয়াবা গডফাদারদের নেপথ্যের হুন্ডি ব্যবসায়ী ৩০ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। টেকনাফ, কক্সবাজার শহর, চট্টগ্রাম এবং ঢাকাকেন্দ্রিক এসব ব্যবসায়ী বৈধ ব্যবসার আড়ালে ইয়াবার অর্থ সংগ্রহ করে দুবাই-সিঙ্গাপুর পাচার করে থাকেন। তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন টেকনাফের বহুল আলোচিত টিটি জাফর। এই টিটি জাফরের সিন্ডিকেটের ১০ সদস্য টেকনাফে অবস্থান করে নানাভাবে ইয়াবার অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন জালিয়াপাড়ার তাহের, আবদুল আলী, লেঙ্গা কামাল, সাইফুল, খোরশিদ। এ ছাড়া এ হুন্ডি চক্রের সদস্য জালিয়াপাড়ার ওসমান, ইসহাক, ইয়াছিন, গোদার বিলের টিক্কা কাদের, সাতকানিয়ার ওসমানের নামও এসেছে স্বীকারোক্তিতে।

এর বাইরে টেকনাফের লামারবাজারের একটি বেকারি, একটি কাপড়ের দোকান, কক্সবাজার শহরের ঝাউতলা এলাকার বিকাশ এজেন্টের নামও এসেছে।

কিন্তু বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন ইয়াবা সাম্রাজ্যের আলোচিত ব্যক্তি সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি, তার ভাই কাউন্সিলর মৌলভি মুজিবুর রহমান, ইয়াবা ডন হাজি সাইফুল করিম, টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাহান মিয়া, বাহারছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভি আজিজ উদ্দিন ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন, টেকনাফের নুরুল হক ভুট্টো, ছিদ্দিক আহমদ।

এদিকে দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিতব্য ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। অনুষ্ঠানের আয়োজন তদারকিতে জেলা পুলিশের পাশাপাশি বিভাগীয় পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাবেদ পাটোয়ারীসহ অন্যরা বৃহস্পতিবার থেকে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। শুক্রবার এসেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তারা।

প্রসঙ্গত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দীর্ঘদিন ধরে কঠোর অভিযান আর নানা পদক্ষেপেও দমন করা যায়নি ইয়াবা কারবারিদের। তবে দেরিতে হলেও দেশে অবস্থানরত চোরাচালানিরা এবং দেশের বাইরে পালিয়ে থাকা গডফাদাররাও আত্মসমর্পণে যুক্ত হয়েছে।

গত বছর মাদকবিরোধী অভিযান ‘মাদকের বিরুদ্ধে, চল যাই যুদ্ধে’ শুরু হবার পর থেকে নানা অভিযানে অর্ধশতাধিক মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সিংহভাগই টেকনাফের অধিবাসী। এসব দেখে আতঙ্কিত অপর ব্যবসায়ীরা প্রাণ বাঁচাতে আত্মসমর্পণে এগিয়ে এসেছেন।

সায়ীদ আলমগীর/এমএমজেড/এসআর/এমএআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।