আপনারা সাংবাদিকরা আমার ছেলেকে ভুলে থাকতে দেন না
২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী দিবস। এ দিন আপনারা সংবাদপত্রের মানুষরা এসে আমাকে আমার ছেলের কথা মনে করে দিয়ে কষ্ট বাড়িয়ে দেন। আমি আমার ছেলেকে ভুলে থাকতে চাইলেও আপনারা (সাংবাদিকরা) থাকতে দেন না। আপনারা কেন আসেন? যাদের জন্য আমার ছেলেটা শহীদ হয়েছে তারা কেউ আমাদের খবর নেয়না। প্রতি বছর তারা অনুষ্ঠান করলেও আমাদেরকে কেউ কোনো দিন ডাকেওনা। ফুলবাড়ী কয়লা খনি হলেই কি, আর না হলেই কি। আমি তো আমার ছেলে হত্যার বিচারও পেলাম না।
অনেক কষ্ট আর ক্ষোভ নিয়ে নিজ বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তরিকুল ইসলামের (২১) মা তহমিনা রহমান।
তরিকুল ইসলাম ২০০৬ সালে ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লা খনি উম্মুক্ত পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর (তৎকালীন বিডিআর) সদস্যদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এদিন খনি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবকারী এশিয়া এনার্জি নামক একটি বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ছিল।
তরিকুল ইসলাম ফুলবাড়ী উপজেলার সুজাপুর চাঁদপাড়া গ্রামের মকলেসুর রহমানের ছেলে। সে তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তো।
শোকাহত মা তহমিনা রহমানের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন তরিকুলের বাবা শিক্ষক মকলেসুর রহমান ও অপর দুই ভাই বাড়িতে ছিলেন না।
তহমিনা রহমান কথার এক পর্যায়ে ঘরে গিয়ে নিহত ছেলের সহপাঠীদের ল্যামিনিটিং করে দেয়া একটি ছবি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলের বন্ধুরা এই ছবিটি না দিয়ে গেলে তার কোনো স্মৃতি আর থাকতো না।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার যা ক্ষতি হবার তা তো হয়ে গেছে। বর্তমান দুই ছেলের ভবিষ্যত নিয়েও আমি চিন্তিত।
তিনি জানান, তরিকুলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকে দ্বিতীয় ছেলে সাদ্দাম হোসেনের মানসিক অবস্থার উপর চাপ পড়ায় কিছুটা হলেও সে লেখাপড়ার প্রতি অমনোয়োগী হয়ে পড়েছে। যদিও সে ডিগ্রি পড়ছে। আর ছোট ছেলে তৌকির আহম্মেদ ভাইয়ের মৃত্যুর দিন পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়। সেই থেকে এখনো তাকে ঢাকায় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে প্রতিমাসে নিয়ে যেতে হয়।
খনি আন্দোলনের নেতারা কোনো খোঁজ খবর নেন কি না এবং তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কেন্দ্রী নেতাকর্মীরা কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করেন কি না জানতে চাইলে তহমিনা রহমান অভিমানের সুরে বলেন, প্রতি বছর ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী দিবস পালন করা হয়। ঢাকা থেকে বড় বড় নেতারা ফুলবাড়ীতে আসেন। কিন্তু কেউ আমাদের খবর নেয় না। অনুষ্ঠানেও আমাদেরকে ডাকা হয় না। এ সময় পাল্টা প্রশ্ন করে তহমিনা রহমান বলেন, আনু মুহাম্মদ ও শহিদুল্ল্যাহকে জিজ্ঞাসা করবেন তো তারা আমার পরিবারের কাউকে চেনে না কি?
এখন তহমিনা রহমানের চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তিনি তার পুত্র হত্যার বিচার চান। চান স্বীকৃতি একটু সম্মান। খবর নিয়ে জানা গেছে, এ ঘটনার পর একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয়েছে মাত্র। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কিংবা পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। অথচ ওই সময় সরকার কথা দিয়েছিল তদন্ত করে হত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের বিচার করা হবে। যা ২৯ আগস্ট তৎকালিন সরকার ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে সম্পাদিত ৬ দফা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে সম্পাদিত ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। ফুলবাড়ীবাসী এই চুক্তির বাস্তবায়ন চায়।
এমএএস