একটি রাস্তাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন
নওগাঁ-নাটোর আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ দশ বছরেও শেষ হয়নি। রেল লাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ৪৮ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২৩ কিলোমিটার পাকা হওয়ার পর ২০০৭ সালে বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণ কাজ। এরপর আট বছর পার হলেও সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। সময়মতো সওজ ও জনপ্রতিনিধিরা ভূমিকা রাখলে এতো বিলম্ব হতো না। সড়কটি নির্মিত হলে নওগাঁর সঙ্গে নাটোর ও ঢাকার দূরত্ব অনেক কমে যাবে। এতে নওগাঁবাসীর যাতায়াতে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে। রাস্তাটি নির্মাণ করা হলে তাদের উৎপাদিত ফসলসহ কৃষিপণ্যের যথাযথ মূল্য পাবেন। তেমনি নওগাঁ ও নাটোরের সড়ক পথ সহজ ও সংক্ষিপ্ত হবে।
এলাকাবাসী এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নওগাঁ-নাটোর আঞ্চলিক মহাসড়কের জন্য ২০০৫ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন দেয়। কিন্তু পরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সীমিত আকারে ৫০ কোটি টাকার অনুমোদন দেয়। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নাটোরের নলডাঙ্গায় নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
এ অর্থায়নে ২০০৭ সালের জুন পর্যন্ত নওগাঁ-সান্তাহার রোডের ঢাকা রোড মোড় থেকে নাটোরের নলডাঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ৪৮ কিলোমিটার রাস্তার মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়। মহাসড়কের নওগাঁ অংশের ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ৭ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হয়। আর নাটোর অংশের ২২ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১৬ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হয়। নতুন করে অর্থায়ন না হওয়ায় মোট ২৩ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হওয়ার পর হাইড্রোলজি সমীক্ষার নামে বন্ধ হয়ে যায় সড়কটির নির্মাণ কাজ।
সড়কটি পাকা না হওয়ায় বাকি সাড়ে ২৫ কিলোমিটার রাস্তা এখন এলাকাবাসীর গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। রাস্তার ওপরে কলার বাগান, সবজি চাষ করছেন এলাকাবাসী। অনেক স্থানে জঙ্গেল হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিষাধর সাপ, শিয়াল, বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণির বসবাস।
রাণীনগর-আত্রাই উপজেলার মাঝখানে শাহাগোলা রেল স্টেশন। এ এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজ পথ একমাত্র ট্রেন। ট্রেনের সময় না থাকায় শাহাগোলা রেল স্টেশন এলাকায় বহলা, ঝুনঝুনিয়া, মাধাইমুড়ি, বেড়াহাসান, শিমলিয়াসহ প্রায় ১০/১২টি গ্রামের লোকজনের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এলাকার প্রধান ফসল ধানের তেমন মূল্য পান না কৃষকরা।
নওগাঁ সরকারি কলেজ পড়ুয়া বহলা গ্রামের কলেজ প্রদীপ কুমার জাগো নিউজকে জানান, গ্রাম থেকে নওগাঁ যেতে রাণীনগর উপজেলার গোনা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে আধাপাকা সরু রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। সব সময় লোকজন চলাচল না করায় যানবাহন পাওয়া যায়না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দুপুরে এবং সন্ধ্যার পর কোনো ভ্যানও চলে না। এতে এলাকাবাসির গোনা ইউনিয়ন থেকে তাদের গ্রাম এলাকার ৪/৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয়।
শাহাগোলা এলাকার খাঁ-পাড়ার বক্তিয়ার হোসেন ও আব্দুর রশীদ জাগো নিউজকে জানান, এ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটাই দুর্গম যে যদি কোনো লোকের দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে দ্রুত আত্রাই বা রানীনগর বা নওগাঁয় হাসপাতলে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনা। কারণ শাহাগোলা থেকে নওগাঁ যেতে আত্রাই উপজেলা মিরজাপুর হয়ে যেতে হয়। এই রাস্তার দূরত্ব প্রায় ২৮/২৯ কিলোমিটার। অথচ নাটোর-নওগাঁ সড়কটি হয়ে গেলে মাত্র ১৫/১৬ কিলোমিটার যেতে হবে। এতে এলাকার হাজার হাজার লোকের ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। আবার কৃষিজাত পণ্যের নায্য মূল্য পাবেন কৃষকরা।
শাহাগোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম মোজাম্মেল হোসেন জাগো নিউজকে জানান, রাস্তাটি সামান্য উঁচু করে কাটা হলেও কোনো সেতু নির্মাণ নেই। এতে ওই রাস্তার অকেজো হয়ে পড়ে থাকায় স্থানীয়া বিভিন্ন ফল ও সবজির বাগান করেছেন। অনেক স্থানে কাঠামোতে শ্যাওলা অনেক গাছ জন্মে গেছে। রাস্তাটি নির্মাণ করা হলে পশ্চাৎপদ এলাকায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হবে। রাস্তাটি দ্রুত নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
নওগাঁ সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল আলিম খান জাগো নিউজকে জানান, এ পর্যন্ত রাস্তাটি নিয়ে বহু টানা-হেচড়া হয়েছে। তবে সামনের অর্থবছরে সড়কটির নির্মাণ কাজ আবার শুরু হবে। রাজশাহী অঞ্চলের জন্য সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত বাজেটে ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন পেতে অন্তত আরও ছয় মাস সময় লাগবে।
তিনি আরো জানান, সড়কটির কিছু অংশ চলনবিল এলাকায় পড়েছে, এজন্য এর স্থায়িত্বের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাইড্রোলজি সমীক্ষা করে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়। সে আলোকে মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সমীক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করে প্রকল্প তৈরি করে একনেকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে এ রাস্তায় আত্রাই নদীর ওপর ব্রিজটা ফোর লেনের ব্রিজ হবে। এটা অর্থায়ন করবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।
নওগাঁ জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, এই রাস্তাটি নির্মাণ হলে বগুড়ার ওপর নওগাঁর নির্ভরশীলতা কমবে। ঢাকা যাওয়ার জন্য নওগাঁবাসীর বিকল্প পথ না থাকায় বগুড়া শ্রমিক ইউনিয়ন নানাভাবে আমাদের জিম্মি করে থাকে। বগুড়ার ওপর দিয়ে যেতে নওগাঁ শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিটি গাড়িকে কমপক্ষে ৪শ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। নওগাঁ-নাটোর সড়কটি নির্মাণ হলে এই দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এ ব্যাপারে নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রাণীনগর) আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম জাগো নিউজকে বলেন, এ সড়কটি বাস্তবায়নের জন্য সংসদে এগারোবার দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। তারপরও প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। অথচ এর চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়েছে। এ সড়কটির প্রায় অর্ধেক কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আর একশো কোটি টাকা বরাদ্দ পেলেই সড়কটি নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব। এজন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দায়ি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এমজেড/আরআইপি