মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়া তারামন বিবির দাফন সম্পন্ন

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কুড়িগ্রাম
প্রকাশিত: ০৮:১০ পিএম, ০১ ডিসেম্বর ২০১৮

বীর প্রতীক তারামন বিবির লাশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তার বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে আসা হয় রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ মাঠে। সেখানে বেলা ২টায় তাকে পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এরপর তার মরদেহে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। পরে জানাজা শেষে উপজেলার কাচারী পাড়া শংকর মাধবপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হয়।

তার প্রতি সম্মান জানাতে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, পুলিশ সুপার মেহেদুল করিম, সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু, কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য রুহুল আমিন মিন, সাবেক এমপি জাকির হোসেন, চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বীর বিক্রম, রাজীবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল আলম, সরকারি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধাসহ আত্মীয় স্বজন এবং বিপুল সংখ্যক গুণগ্রাহী ভক্তরা উপস্থিত হন। এসময় মিলাদ-দোয়া অনুষ্ঠানের জন্য সন্তানদের হাতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৫০ হাজার টাকা দেন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন।

বীর প্রতীক তারামন বিবির ছেলে আবু তাহের জানান, শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘদিন থেকে ফুসফুস ও শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু বলেন, বীর প্রতীক তারামন বিবি জেলার গর্ব ছিলেন। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

kurigram

বীর প্রতীক আব্দুল হাই জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বীর প্রতীক তারামন বিবির অবদান ভোলার নয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময় ধর্মের অজুহাতে নারীরা ঘর থেকে বের হবার সাহস পাননি। কিন্তু তারামন বিবি ছিলেন ব্যক্তিক্রম। তিনি শত বাধা অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা এবং কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে তার সাহসিকতার পরিচয় দেন। নতুন প্রজন্মের কাছে তার স্মৃতি ধরে রাখতে রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা এবং তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান।

মুক্তিযুদ্ধের দলিলাদি সংরক্ষণকারী অ্যাডভোকেট এসএম আব্রাহাম লিংকন পিপি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে বিশেষ করে ১১নং সেক্টরের ইতিহাস রচিত করতে গেলে স্বর্ণাক্ষরে বীর প্রতীক তারামন বিবির নামটি লেখা থাকবে। যুগের পর যুগ ধরে রাখতে বীরপ্রতীক তারামন বিবির কুড়িগ্রামের হলোখানায় নির্মিত বাড়িটিকে একটি মুক্তিযুদ্ধ চর্চাখানা করার দাবি করেন এই তিনি।

জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য আকাশের উজ্জ্বল তারার মতই বীর প্রতীক তারামন বিবির নামটিও মানুষের কাছে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে। তাকে স্মরণীয় করে রাখতে জেলাবাসীর দাবিগুলো তুলে ধরার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

উল্লেখ্য, বীর প্রতীক তারামন বিবির বাড়ি কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের কাচারী পাড়া শংকর মাধবপুর গ্রামে। বাবা আবদুস সোহবান এবং মা কুলসুম বিবি। তারামন বিবি ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য় সন্তান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার একই এলাকার মৃত বরকত আলীর ছেলে আবদুল মজিদের সঙ্গে বিয়ে হয়। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে।

kurigram

১৯৭১ সালে তারামন বিবি নিজ গ্রামে ছিলেন। তখন ১১নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান।

একদিন দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকবাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে। তারামন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন এবং তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারামন অনেক সম্মুখ যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেন। অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান। যুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।

একই সালে ময়মনসিংহের একজন গবেষক প্রথম তাকে খুঁজে বের করেন। এরপর নারী সংগঠনগুলো তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন।

নাজমুল/এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।