‘সন্তানের জন্য কোনো কষ্টই কষ্ট না’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি নেত্রকোণা
প্রকাশিত: ০১:৫৯ পিএম, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

এদেশে অনেক রত্নগর্ভা মা আছেন। তারা সমৃদ্ধ করেছেন দেশমাতৃকার ইতিহাসও। তেমনই এক মহিয়সী মা নেত্রকোনার সীমা সরকার। সীমা সরকারের সেরা হয়ে ওঠার ঘটনার বিশেষত্ব হলো, সীমা সরকার তার শারীরিক প্রতিবদ্ধী ছেলে হৃদয় সরকারকে নিয়ে জীবনের প্রতিটি পদে যুদ্ধ করে চলেছেন। সাধারণত এ ধরনের সন্তানকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে পরিবার। কিন্তু তিনি তার সন্তানকে নিয়ে থেমে যাননি। যুদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তোলপাড় হয় বিভিন্ন মাধ্যমে।

নেত্রকোনা পৌরসভার কুড়পাড় এলাকার বাসিন্দা সীমা সরকার বলেন, জন্ম থেকেই হৃদয় প্রতিবন্ধী। তার রোগের নাম সেরিব্রাল পালসি। চিকিৎসা করিয়েছি কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ভালো চিকিৎসাও নেই। এ অবস্থায় সন্তানকে মানুষ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি, যেকোনো উপায়ে ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলব। বাসায় পড়ানোর পাশাপাশি তাকে স্কুলে কীভাবে ভর্তি করানো যায় সেই ভাবনা ভর করে।

হৃদয়কে নেত্রকোনা শহরের মোক্তারপাড়া হলি চাইল্ড একাডেমিতে প্রথমে ভর্তি করাই। সমাপনী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার পর তাকে নেত্রকোণা শহরের আঞ্জুমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করাই। সেখান থেকে হৃদয় ২০১৬ সালে ৪.০৬ পেয়ে এসএসসি ও ২০১৮ সালে শহরের আবু আব্বাস ডিগ্রি কলেজ এইচএসসি পাস করে।

সীমা জানান, এতদিন হৃদয়কে কোলে করেই স্কুল-কলেজে নিয়ে গেছেন তিনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে কলেজের শিক্ষক ও অধ্যক্ষ তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করেছেন।

গল্প এখানেই শেষ নয়। ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যখন ঢাকায় যান তখন ভিন্নরূপে আবির্ভূত হন সীমা। ‘খ’ ইউনিটের পরীক্ষা। কলা অনুষদে পরীক্ষা দিতে হবে। যখন তিনি হৃদয়কে নিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাসে পৌঁছালেন তখন রিকশা থেকে নেমে ছেলেকে কোলে তুলে নিলেন। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।

তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছা, আমার ছেলেকে আমি নিজে পরীক্ষার হলে বসাবো।’ কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আবু দেলোয়ার হোসেনের কাছে অনুমতি নিয়ে ছেলের পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছে বারান্দায় থাকতে পেরেছিলেন বলেও সীমা জানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায় মেরিট লিস্টে হৃদয় সরকারের স্থান ৩০৪৭। কিন্তু ভর্তির জন্য ফরম তুলতে গিয়ে বাঁধে যত বিপত্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের কেবল ভর্তির সুবিধা রয়েছে। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধীর জন্য কোনো কোটা নেই! এ নিয়ে শুরু হয় মিডিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুশীল সমাজে কথাবার্তা। সর্বশেষ ৯ নভেম্বর সিনেটের সভায় এই আইন সংশোধন করে হৃদয়কে ভর্তির সুযোগ করে দেয়া হয়।

hridoy

এত কিছুর পরও মহিয়সী এ নারী বলেন, সন্তানের জন্য কোনো মায়েরই কষ্ট হয় না। আমার তো আরও হয়নি, কারণ আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। তাকে তো বেশি যত্ন করতে হবে। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য আর আমার স্বপ্নপূরণে এ কষ্ট কিছুই না। প্রয়োজনে আমি আরও কষ্ট করব।

সম্প্রতি বিবিসির করা জরিপে বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদানকারী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ৮১তম স্থান পেয়েছেন নেত্রকোণার সীমা সরকার। সন্তানের শিক্ষার জন্য তিনি কখনোই পিছপা হননি। হবেনও না। বিশ্বের ৬০টি দেশের ১৫ থেকে ৯৪ বছর বয়সী বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বিবিসি অনলাইনে ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

বিবিসির এই তালিকায় আরও আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মেয়ে চেলসি ক্লিনটন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ও পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু নারী সিনেটর কৃষ্ণকুমারীর মতো বিশ্ববিখ্যাত নারীরাও।

বিশ্বের ১০০ জনের মাঝে তার নাম শুনে সীমা প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি এতকিছু বুঝি না। তবু একজন মা বা মহিলা হিসেবে এই নাম শুনতে অনেক ভালো লাগে। আমার ভবিষ্যৎ কাজের অনুপ্রেরণা এই স্বীকৃতি।

সীমা সরকার আরও বলেন, তার স্বামী ইটভাটার ম্যানেজার। টানা পোড়নে সংসার চলে। এই অবস্থার মাঝে হৃদয়ের জন্ম হয় ২০০০ সালে। জন্ম থেকেই সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। জন্মের পর তাকে অবহেলা করিনি। হতাশ হইনি। স্বপ্ন দেখেছি তাকে নিয়ে, কষ্ট করেছি, তাই হয়তো তার সফলতা দেখে যেতে পারব।

হৃদয় সরকার বলেন, আমার স্কুল থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পেছনে সবকিছুই মায়ের কৃতিত্ব। মা আমাকে বলেন, তুমি লেখাপড়ার জন্য যতদূর যেতে চাও আমি সবটুকুই করবো। মা তা-ই করে যাচ্ছেন।

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মঈনুল ইসলাম বলেন, হৃদয় সরকার সমাজের অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। অনেকেই আছেন যারা প্রতিবন্ধী সন্তান হলে তাদের আশা ছেড়ে দেন। শিক্ষা-দীক্ষায় তাদের গুরুত্ব দেয়া হয় না। এক্ষেত্রে হৃদয় সরকার এবং তার মা অনন্য উদাহরণ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদয়ের চলাফেরার জন্য একটি ব্যাটারিচালিত হুইল চেয়ার প্রদান করা হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

কামাল হোসাইন/এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।