রাজকীয় রিসোর্টের আড়ালে চলে অসামাজিক কাজ
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রাজকীয় ‘শীতলক্ষ্যা রিসোর্ট’ রেস্ট হাউজে চলে অসামাজিক কাজ। পাশাপাশি রিসোর্টে আসা অতিথিদের হয়রানি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়।
একই সঙ্গে ভোলাব পুলিশ ফাঁড়ির এসআই সাব্বিরের টর্চারসেল হিসেবে পরিচিত এ রিসোর্ট। এসব অভিযোগ করেছেন রিসোর্টে হয়রানি ও এসআইয়ের হাতে নির্যাতনের শিকার কয়েকজন ভুক্তভোগী।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজউকের নির্মাণাধীন পূর্বাচল উপশহরকে ঘিরে আশপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিনোদন কেন্দ্র। ফলে এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন বেড়াতে আসে।
বিনোদন কেন্দ্রে আসা দর্শনার্থীদের লক্ষ্য করে উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার বিরাব এলাকায় শীতলক্ষ্যা রিসোর্ট তৈরি করেন শিল্পপতি ইলিয়াস জাকারিয়া।
তার রিসোর্টে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে তরুণ-তরুণী, প্রেমিক-প্রেমিকা এককথায় যুগলদের রাতযাপনে বিশেষ সুবিধা দেয় রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে ধনীর দুলালী হলে আগে থেকেই রুম বরাদ্দ রাখা হয়।
পাশাপাশি রাজকীয় এ রিসোর্টে অবাধে চলে অসামাজিক কাজ। এজন্য রয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যুগলদের প্রথমে রিসোর্ট ভাড়া দিলেও রাতযাপনের পরের দিন চলে ভিন্ন বাণিজ্য। বিষয়টি গোপন রাখার শর্তে যুগল ও যুবকদের জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন রিসোর্টের প্রহরী এবং ম্যানেজার।
তবে অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার সময় বাধে বিপত্তি। অনেকে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার ভয়ে অতিরিক্ত টাকা গুনলেও স্বামী-স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে আসা লোকজন এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন।
তখনই ভোলাব পুলিশ ফাঁড়ির এসআই সাব্বিরকে খবর দেন রিসোর্টের প্রহরী আবুল হোসেন ও বারাকাত। তাৎক্ষণিক এসআই রিসোর্টে এসে দফারফা করে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মারধর, পরে টাকা নিয়ে ছাড়া হয় ওসব ব্যক্তিদের।
কয়েকদিন আগে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার সুমন ও তার স্ত্রী রেবেকা। পূর্বাচলে ঘুরতে আসার পর শীতলক্ষ্যা রিসোর্টে রাতযাপন করতে যান তারা।
সুমন বলেন, সুইমিং সুবিধা থাকায় পরেরদিনও থেকে যাই রিসোর্টে। ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ পরিশোধ করে পরেরদিন রিসোর্ট ত্যাগ করার সময় আমাদের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন রিসোর্টের প্রহরী আবুল হোসেন। কিসের টাকা? কেন অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে এসব নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে এসআই সাব্বিরকে খবর দেন প্রহরী আবুল। পরে এসআই রিসোর্টে এসে আমাদের হয়রানি করেন, সেইসঙ্গে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেই ছাড়েন। ভয়ে ওই সময় বিষয়টি কাউকে জানাতে পারিনি।
জানা যায়, উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মী ও মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে এনে ভোলাব ফাঁড়ি বা থানায় না নিয়ে রিসোর্টে আটকে রাখেন এসআই সাব্বির। এখানে তাদের ওপর চলে নির্যাতন। কথা কাজে মিল থাকলে হয় দফারফা। টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়। টাকা না পেলে রিসোর্টের কক্ষে আটকে রেখে চালানো হয় নির্যাতন। তাই স্থানীয়দের কাছে টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত এ রিসোর্ট।
রূপগঞ্জের কাঞ্চন ৫নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সামসুল মিয়া বলেন, নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলায় আমাকে ফাঁসানো হবে- এমন ভয় দেখিয়ে ১৫ নভেম্বর বাড়ি থেকে আমাকে আটক করেন এসআই সাব্বির।
পরে আমাকে শীতলক্ষ্যা রিসোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করেন এসআই। টাকা দিতে না পারায় আমাকে টর্চার করা হয়। এ সময় রিসোর্টে আমার আত্মীয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার অনুরোধে টর্চার থামানো হয়। পরে নেয়া হয় ভোলাব পুলিশ ফাঁড়িতে। সেখান থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে আমাকে ছাড়িয়ে আনে মেয়ের জামাই।
একইভাবে শীতলক্ষ্যা রিসোর্টে এসআই সাব্বিরের টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কেরাবো এলাকার সাইফুল, কেন্দুয়া এলাকার মানিক ও ভোলাব এলাকার নয়ন মিয়া।
তারা বলেন, আমাদের নামে কোনো মামলা ও অভিযোগ নেই। আমাদের ধরে শীতলক্ষ্যা রিসোর্টে নিয়ে মারধর করে টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দেন এসআই সাব্বির। স্থানীয় যুবকদের ধরে ওই রিসোর্টে নিয়ে প্রথমে নির্যাতন। পরে অর্থের বিনিময়ে ছাড়েন এসআই সাব্বির। এসব বিষয়ে মুখ খুললে খুনের মামলায় ফাঁসানো হবে বলেও হুমকি দেন এসআই।
এদিকে, রিসোর্টটিতে চলে নানা অপকর্ম। দম্পতি ও প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কক্ষ প্রতি এসি ১০ হাজার আর নন-এসি ৬ হাজার টাকার কথা লেখা থাকলেও আদায় করা হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
আবাসিক হোটেলের মতো সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় রিসোর্টটিতে। রাতে চলে দেহ ব্যবসা। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়ে রিসোর্টটিতে এমন অপকর্ম চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিসোর্টের এক কর্মচারী বলেন, কলেজশিক্ষার্থী তরুণ-তরুণী, প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়াও অনেক যুবক এখানে অন্য মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটাতে আসেন। নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন, পুলিশ প্রশাসনকে নিয়মিত টাকা দেয়া হয়। এসব বিষয় রিসোর্ট ম্যানেজার ম্যানেজ করেন। তাই এখানে নিরাপদভাবে যে কেউ সঙ্গী নিয়ে রাতযাপন করতে পারেন। তবে মাঝেমধ্যে কিছু অনিয়মও হয়। আমার নাম বলবেন না, তাহলে আমার চাকরি শেষ।
এ নিয়ে রিসোর্টের প্রহরী আবুল হোসেন বলেন, এখানে সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য আমরা সবসময় সজাগ থাকি। তবে কাউকে হয়রানি করা হয় বিষয়টি আমার জানা নেই। যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তাদের আমি চিনি না।
শীতলক্ষ্যা রিসোর্টের ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান বিপু বলেন, বিধি অনুযায়ী পর্যটকদের সব সুবিধা দেয়ার জন্য তৈরি হয়েছে এই রিসোর্ট। এখানে পর্যটকদের রাত যাপনের অনুমতি রয়েছে। তবে কে বৈধ দম্পতি আর কে প্রেমিক-প্রেমিকা তা নির্ণয় করা হয় না। স্থানীয় পুলিশ সবসময় নিরাপত্তার জন্য এখানে আসা-যাওয়া করেন। এসআই সাব্বির মাঝেমধ্যে লোকজন নিয়ে আড্ডা দিয়ে চলে যান। এখানে কোনো মাদক সেবন কিংবা কাউকে হয়রানি করা হয় না। দম্পতি ও যুগলদের হয়রানির বিষয়টি আমার জানা নেই। এ নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি।
এ বিষয়ে পুলিশের এসআই সাব্বির বলেন, আমি একা নই, আমার টিমের অনেক সদস্য ওই রিসোর্টে চা খেতে যান। এখানে কোনো টর্চার সেল নেই। কাউকে হয়রানিও করা হয় না। যারা অভিযোগ করেছে তাদের অভিযোগ মিথ্যা।
ভোলাব পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ শহিদুল হক বলেন, এসআই সাব্বিরের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ শুনেছি। তবে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। শীতলক্ষ্যা রিসোর্টে মাঝেমধ্যে চা খেতে যাই। তাদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেয়া হয় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, রূপগঞ্জে রিসোর্টের আড়ালে এমন কাজ চলছে তা আমার জানা নেই। রিসোর্টে রাতযাপনের অনুমতি নেই। তাদের অনুমোদন আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখতে হবে। অসামাজিক কাজের প্রমাণ পেলে রিসোর্টের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এএম/পিআর