জয়পুরহাট চিনিকলে বেতন বাকি ২ কোটি টাকা
দেশের সবচেয়ে পুরাতন জয়পুরহাট চিনিকলটিতে নেই প্রাণের স্পন্দন। সুদূর অতীতে এ চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের জীবনযাত্রা ছিল অভিজাত শ্রেণির। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে অতীতের সেই স্বর্ণালী দিনগুলো। প্রায়ই তাদের বেতন-ভাতা বকেয়া থাকলেও এবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী আর কখনও দেখা যায়নি। ৫ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীর প্রায় ২ কোটি টাকা বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে গেল ২ মাস ধরে। এতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাদের অনেকেই।
জয়পুরহাট চিনিকলের শ্রমিক খালাসি রমজান আলীর চাকরির বয়স ৫৫ বছর। তিনি ২ যুগেরও বেশি সময় পার করেছেন উত্তরাঞ্চলের ভারী এ শিল্প-কারখানায়। যৌবনের প্রথম ভাগে চিনিকলের চাকরিতে ভালো বেতন ছিল বলে রমজান আলীর জীবনটাই ছিল অন্য রকম। কিন্তু গত ২ মাস ধরে বেতন না পাওয়ায় তার অবস্থা খুবই দুর্বিসহ।
বেতন নেই বলে কখনো রিকশা চালান আবার কখনও জঙ্গলের শাক-সবজি তুলে বিক্রি করে তা দিয়েই চলছে রমজান আলীর সংসার।
চিনিকলের আরেক শ্রমিক বিদ্যুৎ বিভাগের হেল্পার জাফর আলী। তিনিও বেতন না পাওয়ায় সংসার চালাতে চাকরির সময় শেষ করে পরিবারকে না জানিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান।
শুধু জাফর আলী বা রমজান আলীই নয়, ওয়ার্কশপ হেলপার সমারু কর্মকার, ইলেকট্রিক মেকানিক প্রশান্ত কুমার, মিল হাউসের ফোরম্যান রফিক উদ্দিনসহ অনেকেই চাকরির ফাঁকে অথবা চাকরি শেষ করে আবার কেউ ছুটি নিয়ে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।
জয়পুরহাট চিনিকলে ১ হাজার ৩০ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে দূরাবস্থার শিকার ৫৩০ জন শ্রমিক-কর্মচারী বেতন পাননি গেল ২ মাস ধরে। বেতন ভাতা না পাওয়ায় তাদের জীবন-জীবিকা হয়ে পড়েছে দুর্বিসহ।
অন্যদিকে মৌসুমী ও চুক্তিভিক্তিক শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে ৫০০ জন। তারাও কাজে যোগ দেবেন আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে।
চিনিকলের প্রশাসন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৬১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ২১৭ একর জমির ওপর জয়পুরহাট চিনিকলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাট চিনিকলটির প্রথম আখ মাড়াই শুরু হয়। গত মৌসুমের উৎপাদিত ১ হাজার ৪শ মেট্রিক টন চিনি যার মূল্য সাড়ে ৭ কোটি টাকা এবং ৪ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৩শ মেট্রিক টন চিটাগুড় (মোলাসেস) অবিক্রিত রয়েছে। আর এ কারণেই শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন ভাতাও বকেয়া রয়েছে।
এদিকে লোকসান ঠেকাতে এবং আয় বৃদ্ধি করতে মিলের অব্যবহৃত অসমতল জমিকে সমতল,পরিত্যক্ত ভবন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে কচু চাষ, ড্রাগন, ভিয়েতনাম ওপি হাইব্রিড নারিকেল বাগান এবং মাশরুম চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু এতে লোকসান কমে যাওয়া তো দূরের কথা বোঝা যেন আরও ভারী হচ্ছে বলে একাধিক শ্রমিক জানান।
চিনিকলের বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব রুমেল জানান, জয়পুরহাট চিনিকলের ৫০০ শ্রমিকের গত ২ মাসের বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। কলকারখানার প্রাণ শ্রমিকদের এ পাওনা ভর্তূকি দিয়ে হলেও পরিশোধ করার দাবি জানান তিনি।
জয়পুরহাট চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, বেসরকারি চিনিকলগুলো বাইরে থেকে তরল সুগার নিয়ে এসে কম মূল্যে চিনি উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। আর আমরা আখ থেকে চিনি তৈরি করার কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। এতে কম মূল্যে চিনি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্রেতারা যে চিনি কম দামে পাবে সেটাই কিনবে। আমরা যদি চিনির দাম কমিয়ে দেয় তখন কোম্পানিগুলোও চিনির দাম কমিয়ে দেয়। ফলে আমাদের চিনি অবিক্রিতই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন বলেন, চিনির মূল্য যদি লবণের মূল্যের কাছাকাছি আসে তাহলে এ শিল্প ভালো করবে না এটাই স্বাভাবিক। সব কিছুর দাম বাড়লেও চিনির মূল্য কমে বর্তমানে ৪০-৪২ টাকা কেজি। মিলে উৎপাদিত চিনি ও মোলাসেস বিক্রি করে বেতন দিতে হবে এবং এ খাতে সরকারের সরাসরি টাকা দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। তাই যা আছে তাই দিয়ে সমন্বয় করে চলতে হবে এবং এই সমস্যা সম্পর্কে শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে।
রাশেদুজ্জামান/এফএ/জেআইএম