কক্সবাজার-৩ আসন নিয়ে টেনশনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৭:৩২ পিএম, ০৬ নভেম্বর ২০১৮

চলতি সরকারের সময়ে কক্সবাজারে চলছে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প রেললাইন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্টজোনসহ চলছে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। এসব বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজার হবে দেশের জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

বর্তমানে এসব কারণ আর আগে থেকেই পর্যটন স্পট ও জেলা সদর আসন হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে কক্সবাজার-৩ আসনটি ভিআইপি আসন হিসেবে গণ্য। তাই এ আসনে মনোনয়ন পেতে সব দল থেকেই প্রতিযোগিতা চলছে। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা যে যার মতো মাঠ-ঘাট চষে বেড়ানোর পাশাপাশি কেন্দ্রেও লবিং চালাচ্ছেন।

এসব কারণে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সব জোটের শরীক দলে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রার্থিতা নিয়ে মাঠে-ঘাটে রয়েছেন। ক্ষমতাশীন দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী আওয়ামী লীগে। রয়েছে জাতীয় পার্টি, বিএনপি, নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতসহ নানা দলের প্রার্থী। তারা জনসর্মথনে জয় নিয়ে পর্যটন শহরে নিজ দলের আধিপত্য জানান দিতে প্রস্তুত।

কক্সবাজার জেলা নির্বাচন অফিস সূত্র মতে, কক্সবাজার সদর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন এবং রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়েই কক্সবাজার-৩ আসনটি গঠিত। এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১৪ হাজার ৩৬ জন। সদর উপজেলায় ১০৮টি ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে এক লাখ ৩৫ হাজার ১৪ জন পুরুষ ও এক লাখ ২১ হাজার ৪ জন নারী মিলিয়ে ভোটার রয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ১৮ জন। আর রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ৬১ ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে ৮১ হাজার ৪১০ জন পুরুষ ও ৭৬ হাজার ৬০৮ নারীসহ ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৫৮ হাজার ১৮ জন।

তবে, রাজনৈতিক বোদ্ধামহলের মতে, কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলা ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে বরাবরই বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর বিএনপি সারাদেশের মতো কক্সবাজারেও প্রত্যন্তাঞ্চলে নিজেদের সমর্থন বাড়ায়। আর দীর্ঘ বছর তারা ক্ষমতায় থাকার কারণে এখানে সাংগঠনিকভাবে অবস্থান শক্ত করে।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে টানা তিনবার এ আসনে নির্বাচিত হয়ে জয়ের সুফল ঘরে তুলেছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। এ কারণে এখনও তাদের প্রার্থিতা সুসংহত বলে দাবি করা হলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাঠে আসার পর বিএনপিতেও মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা। আর বর্তমান ক্ষমতাশীন দল আওয়ামী লীগেতো একাধিক প্রার্থী মাঠেই রয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীই জয়ী হবেন এমন প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা প্রেমি সবার। তাই ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভাগ্যজোরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাইমুম সরওয়ার কমল আবারও প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে জোরালোভাবে মাঠে রয়েছেন।

তার পাশাপাশি কক্সবাজার সদর আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন কমলের বোন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী, ভাই রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কানিজ ফাতেমা আহমেদ, ওয়ান ইলাভেন পূর্ববর্তী ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাশেদুল ইসলাম, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ ও কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম। এমপি হিসেবে সরকারি প্রোগ্রামে সাইমুম সরোয়ার কমল মাঠে রয়েছে। বাকি মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও চষে বেড়াচ্ছেন মাঠ-ঘাট। যোগাযোগ রাখছেন দলের হাইকমান্ডের সঙ্গেও।

নৌকা প্রত্যাশীদের মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কক্সবাজারে লাখো কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করছে। এর মধ্যে চারটি বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন প্রকল্প, মেরিন ড্রাইভ সড়ক, পর্যটনে ছয়টি মেগা প্রকল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অন্তত ৬৯টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। বাস্তবায়ন হয়েছে সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের। তাই আগামী নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের জয় অনেকটা সহজ হবে।

মনোনয়ন প্রত্যাশী রাশেদুল ইসলাম বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই দলের দুঃসময়ে মাঠে থাকার ইতিহাস আমার। এটি নেত্রীসহ কেন্দ্রের অনেকে জানেন। তাই মনোনয়ন পেলে তৃণমূলকে নিয়ে নৌকার বিজয় প্রিয় নেত্রীকে উপহার দেয়া অসম্ভব নয়। এরপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেবেন, তার পক্ষেই কাজ করবো আমি। তবে, জনবান্ধব ও তৃণমূলের পছন্দের যোগ্য ব্যক্তিই মনোনয়ন পাবেন বলে আশা রাখছি।

কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নজিবুল ইসলামের মতে, দায়িত্ব পাবার পর থেকে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করছি। যার ফল সরূপ সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচনে নৌকার অবিস্মরণীয় জয়।

কানিজ ফাতেমা আহমদ জানান, তৃণমূল পর্যায়ে মহিলা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন বার্তা সবার কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। স্বামী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরীও কাজ করছেন। সব মিলিয়ে দলীয় মনোনয়ন তার পক্ষে যাবে।

বর্তমান এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের ছোট বোন নাজনীন সরওয়ার কাবেরী জানান, অধিকার বঞ্চিত মানুষের হয়ে কথা বলার জন্য তিনি প্রার্থী হচ্ছেন। বিশেষ করে তিনি নারী নেতৃত্ব তৈরির কাজে বিশেষভাবে আগ্রহী বলে জানান।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা থাকা লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ অবসরে আসার পর থেকেই প্রচার পায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নৌকার প্রার্থী হবেন। কৌশলগত কারণে তিনি সবার থেকে এগিয়েও থাকবেন। এরই মাঝে তিনি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দু'মেয়াদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করছেন। এরপর থেকে সেই আলোচনা এখনও চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে তার উন্নয়ন অগ্রযাত্রার হাত শক্তিশালী করতে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি। তবে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যাকে মনোনয়ন দেবেন তার জয় নিশ্চিতে এক সঙ্গে কাজ করবো।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বলেন, আমরা সবার মতামত নিয়ে বেশ কয়েকজনের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। দলীয় হাইকমান্ড নিজেদের মতো করে সবার কর্মক্ষমতা যাচাই করছেন। দলীয় প্রধান যাকে মনোনয়ন দেবেন আমরা তার কর্মী হিসেবে সেই প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমে নৌকার জয় নিশ্চিত করবো।

অসমর্থিত একটি সূত্র মতে, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান মেয়র মুজিবুর রহমানও এমপি প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন। সবদিক বিবেচনায় এনে হাইকমান্ড শেষ পর্যন্ত হয়তো তাকেও কক্সবাজার-সদর আসনে মনোনয়ন দিয়ে বসতে পারেন।

মহাজোটের শরীক দল জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছে কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক। গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও নানা নাটকীয়তায় পার্লামেন্টে যাবার সুযোগ হাতছাড়া করেন জেলা জাপার সেক্রেটারি মুফিজ আহমদ। তাই এবার আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন অ্যাডভোকেট তারেক।

অন্যদিকে, ১/১১ পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ায় কেন্দ্রে একটি ভালো ইমেজ রয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় মৎস্যবিষয়ক সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজলের। তাই একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও তিনিই বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সবার নখদর্পনে ছিলেন। সেভাবেই তিনি শহর-গ্রাম মাড়িয়ে প্রত্যন্তঞ্চলে সবসময় যোগাযোগ রেখে চলেছেন। কিন্তু সম্প্রতি মাঠে আসা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কারণে এখন বিএনপি থেকে সহিদুজ্জামান আবার নির্বাচন করতে পারে বলে রাজনৈতিক মাঠে প্রচারণা পাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপির সাবেক সাংসদ সহিদুজ্জামান বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। তারপরও আওয়ামী লীগ এবং বিদ্রোহী প্রার্থীকে পেছনে ফেলে আমি বিপুল ভোটে বিজয়ী হই। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিই আমার মূলমন্ত্র ছিল বলেই জয় পেয়ে বিরোধী দলীয় এমপি হয়েও এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছি। সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছি। এসব কারণে দলের মনোনয়ন আমার পক্ষে থাকবে। নির্বাচনে ব্যালট পেলে মানুষ আমাকে এখনও মূল্যায়ন করবে বলে আমার বিশ্বাস।

জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদ আমাদের নেতা। কক্সবাজার বিষয়ে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটিই বাস্তবায়িত হবে। আমরা তার নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি। আমরা দলীয় স্বার্থে সবসময় ঐক্যবদ্ধ।

অপরদিকে, ইতোপূর্বে কক্সবাজারের চারটি আসনেই জামায়াত-শিবির একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতো। উপকূলীয় জেলা হিসেবে এতদঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ ধর্মভীরু। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে পরপারের কথা বলে জামায়াত নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা চালাতো। কিন্তু এখন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল, আর ডিজিটাল যুগ হিসেবে স্বল্পশিক্ষিতরাও সচেতন। তাই মানুষ এখন আর অলীক স্বপ্নে পা দেবে না। এরপরও জামায়াতে ইসলামীর জেলা সেক্রেটারি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম রহিমুল্লাহ এ আসনে প্রার্থী হতে পারেন এমনটি ধারণা রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের। জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে এ আসনটি ছেড়ে দেয়ার জন্য জোরালো দাবি থাকবে তাদের। এখন আসলে মাঠে কারা আসছে, কে কাকে ছাড় দিচ্ছে এটি দেখতে সামনের তফসিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সবদলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের।

এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।