জাদুকর সেলিমের গল্প
বাড়ির পাশে ‘দ্যা নিউ স্টার সার্কাসে’ নিয়মিত জাদু খেলা দেখতো স্কুলছাত্র রুহুল আমিন সেলিম। জাদুর নেশায় প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিতো পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সেই দূরন্ত শিশু। কৌতুহলী সেলিম জাদু শিখতে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশও হয়েছে বহুবার। সেজন্য অবশ্য শাস্তিও পেতে হয়েছে তাকে। বাড়ির লোকজন বাধ্য হয়ে শিকলে বেঁধে রাখতো তাকে।
সেলিম ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের লোকনাথ দিঘিরপাড়ের মৃত আলী আজগরের ছেলে। শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কাটিয়ে সেলিম এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব।
শখের বশে স্কুলজীবনেই জাদুর বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করেন সেলিম। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাদু দেখিয়ে অর্জন করেছেন বহু পুরস্কার। জাদু দেখাতে বন্ধুদের নিয়ে একটি দলও গঠন করেছিলেন তিনি। তবে কখনোই অর্থের জন্য জাদু দেখাননি সেলিম।
পরিবারের চাপে সেলিমের জাদুর সেই দল খুব বেশিদিন টেকেনি। জাদু নিয়ে সেলিমের ‘পাগলামির’ কারণে পরিবারের লোকজন তাকে পাঠিয়ে দেন সৌদি আরব। শখের জাদু ফেলে প্রবাসে পাড়ি জমালেও জাদুর নেশা এখনো কাটেনি তার। সেই নেশা প্রায় ৩০ বছর পর আবারও তাকে নিয়ে এসেছে জাদুর মঞ্চে। জাদু দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে নিজে আত্মতৃপ্ত হন সেলিম। প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের সঙ্গেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন তিনি।
জাগো নিউজকে সেলিম শুনিয়েছেন তার জাদুকর হয়ে ওঠার সেই গল্পই। গল্পের প্রতি ভাজে জাদু নিয়ে সেলিমের শুধুই কৌতুহল।
জাদু কোনো মন্ত্র নয় বরং পুরোটাই কৌশল উল্লেখ করে সেলিম জানান, শহরের অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় লোকনাথ দিঘিরপাড়ে প্রায়ই ‘দ্য নিউ স্টার সার্কাসে’ জাদু দেখতেন তিনি। রুমাল থেকে কবতুর হয়ে যাওয়া আর একটা মেয়েকে তিন টুকরো করার মতো ‘চোখ ধাঁধানো’ জাদু নিয়ে মনে কৌতুহল জাগে তার। কিভাবে এসব সম্ভব সে চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটতো তার। এরপর একদিন নিজেই জাদু শেখার জন্য মনস্থির করেন। ফেলু পাল নামে এক জাদুশিল্পীর কাছে তার হাতেখড়ি হয়। বেদে সম্প্রদায়ের কেউ কেউ জাদু শেখায় শুনে বাড়িতে না জানিয়ে বেদেদের দলেও ভেড়েন সেলিম।
দলে ঢোকার জন্য কাউকে মা কাউকে ভাই ডাকতেন। চাল থেকে পয়সা বানানোর জাদু শেখার জন্য বহুবার ঘর থেকে চাল চুরি করে নিয়ে গেছেন তিনি। বেদেদের কাছ থেকে জাদু খেলার কিছু কৌশলও রপ্ত করেছিলেন সেলিম।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় লোকমুখে শুনে জাদু শেখার জন্য ভারতের আসাম ও কামরুকামাক্ষাসহ বিভিন্ন স্থানে যান তিনি। ভারত থেকে জাদুর কিছু বইও কেনেন তিনি। পুরোপুরিভাবে জাদুকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসেন সেলিম।
তিনি জানান, শুরু থেকেই জাদুর প্রতি তার বাবা-মায়ের সায় ছিল না। পাড়া-প্রতিবেশীরা প্রায়ই তার বাবা-মায়ের কাছে এসে বলতেন তিনি জাদু-টোনা ও কুফুরি করেন। যেগুলো ইসলাম ধর্মে হারাম। আর বাবা-মা ধার্মিক হওয়ায় তাকে নিষেধ করতেন যেন জাদু ছেড়ে দেন। কিন্তু বাউণ্ডুলে সেলিমের কৌতুহলী মন বাবা-মায়ের সেই নিষেধ না মেনে সারাদিন পড়ে থাকতো জাদু নিয়েই।
এই জাদুর জন্য মায়ের স্বর্ণালঙ্কার পর্যন্ত চুরি করে বিক্রি করেছিলেন সেলিম। শহরে কোনো অনুষ্ঠান হলেই জাদু খেলা দেখানোর জন্য ডাক পড়তো সেলিমের। তবে বাড়ির লোকজন তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন না, তার জন্য পাহারায় থাকতো বাড়ির সবাই। বহুবার তাকে মারধর করে শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। পরে বাধ্য হয়েই তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সেলিম আরও জানান, মানুষকে শূন্যে ভাসমান রাখা, একজন মানুষকে তিন টুকরো করা, রুমাল থেকে কবুতর তৈরি করা, ব্ল্যাকবোর্ডে নাম বললে ছবি ওঠা, কলস থেকে পানি পড়তে থাকাসহ প্রায় শতাধিক খেলা তিনি জানেন।
১৯৭৮ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি সর্বশেষ জাদু খেলা দেখিয়ে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর চলে যান সৌদি আরব। চার বছর সেখানে থেকে দেশে ফিরে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন।
অর্থনৈতিক মুক্তির পর গেল কয়েক মাস ধরে আবারও পুরনো সেই জাদুতে মেতেছেন তিনি। শখের সেই জাদুর জন্য লাখ টাকা খরচ করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছেন। এখন শহর ও গ্রামের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানে গিয়ে জাদু দেখান শুধুমাত্র মনের প্রশান্তির জন্য।
তার ইচ্ছা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে কামান তৈরি করে সেই কামানের উপর একজনকে বসিয়ে জাদুর মাধ্যমে আকাশে উড়িয়ে দেয়া। এজন্য সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তবে জাদু খেলাকে আরও বিকশিত করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি এই শখের জাদুকরের।
আজিজুল সঞ্চয়/এফএ/আরআইপি