বাংলাদেশে সংসার পাতলেন ফরাসি তরুণী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কুষ্টিয়া
প্রকাশিত: ০৯:১১ পিএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৮

দেবোরা কিউকারম্যান। ফ্রান্সের নাগরিক। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। দেবোরা একজন ভালো ট্রান্সলেটর। দেশে থাকাকালীন ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের কাজও করেছেন। শুধু তাই নয়, দেবোরা দর্শনে এমএ করেছেন। ফ্রান্সে ইয়োগার শিক্ষক ছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশে আসার পর বাউল সম্রাট লালন শাহ-এর জীবনদর্শন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে লালন দর্শনের প্রেমে পড়ে যান দেবোরা। আত্মিক শান্তির উদ্দেশ্যে এদেশে এসে গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন। বাউলদের এই জীবনাচারে প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

বাউল সম্রাট লালন শাহ-এর কথা শুনে কাছ থেকে লালনের জীবন ও দর্শন উপলব্ধি করার জন্য ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম বাংলাদেশে আসেন দেবোরা। এরপর থেকে বসবাস করছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। এর মধ্যে কয়েকবার ফ্রান্সে গেছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর বেশি দিন থাকতে পারেননি।

কয়েকদিন পরই লালনের প্রেমের টানে আবারও ফিরে এসেছেন লালন ধামে। ফিরে এসে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন এই তরুণী। নাম বদলে হয়েছেন দেবোরা জান্নাত।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় ছেঁউড়িয়ায় চলছে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ-এর ১২৮তম তিরোধান দিবস। লালন একাডেমির নিচে হাজারো বাউল-সাধু, শিষ্য-গুরুর সঙ্গে মঙ্গলবার দুপুরে দেখা মিলল ফরাসি তরুণী দেবোরা জান্নাতের সঙ্গে। তিনি প্রখ্যাত বাউল ফকির নহির শাহ-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। সেই সঙ্গে মা-বাবার রাখা নামটি পরিবর্তন করে হয়েছেন দেবোরা জান্নাত।

এ বিষয় নিয়ে কথা হয় দেবোরা জান্নাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে প্রথম লালনের দেশ কুষ্টিয়ায় আসি। লালনের গবেষণার জন্য এসে আমি আর ফিরে যেতে পারিনি। মায়া পড়ে গেছে। প্রথমে আমি বাংলা ভাষা জানতাম না। কিন্তু ভাষা না জানলেও আমি গুরুজির সঙ্গে সাধুসঙ্গতে গেলাম। সাধুসঙ্গতে গিয়ে সেখানকার শৃঙ্খলা ও ভাব-বিনিময়ের মধ্যে যে লালন দর্শন পেলাম সেখানে ভাষা কোনো বিষয়ই ছিল না।

যেমন কর্ম তেমন ফল উল্লেখ করে দেবোরা জান্নাত বলেন, লালন সাঁইজির দর্শন যারা মানেন, সাধনা করেন, তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। তবেই সৃষ্টির এই বিস্ময় জানা সম্ভব হবে। ধর্মের চেয়ে সাঁইজির কাছে ছিল মানুষ বড়। ধর্ম কিংবা জাত-পাতের মধ্য দিয়ে নয়, ঈশ্বরকে পেতে হলে, তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে জানা দরকার সুপথের সন্ধান।

জান্নাত আরও বলেন, লালন সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই কুষ্টিয়ায় আসা। গুরুজি নহির শাহ-এর কাছ থেকেই শিষ্যত্ব নিয়েছি। আমৃত্যু সাধুসঙ্গ নিয়ে বাংলাদেশে থাকতে চাই।

দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুরে ফকির নহির শাহ-এর আস্তানায় জান্নাতের বসবাস। কিছু দিন আগে এই আস্তানায় বসবাসকারী নহির শাহ-এর আরেক শিষ্য রাজনকে বিয়ে করেছেন দেবোরা জান্নাত। পেতেছেন সংসার।

কারণ হিসেবে দেবোরা জান্নাত উল্লেখ করেন, সংসার হলো সমাজ, সংসার হলো ঘর। এই চিন্তা-চেতনা থেকে ঘর-সংসার করতেই গুরুজির শিষ্যকে বিয়ে করেছি।

ফ্রান্সে আর ফিরে যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে দেবোরা জান্নাত বলেন, আমি শান্তি খুঁজে পেয়েছি এদেশে, এই লালনের প্রেমে। তাই আমি আর ফিরে যাবো না ফ্রান্সে।

দেবোরা জান্নাতের বিষয়ে ফকির নহির শাহ বলেন, ফ্রান্স থেকে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আসেন জান্নাত। সত্যের সন্ধানে পৃথিবীর প্রায়ই ১৫টি দেশ ঘুরে অবশেষে বাংলাদেশে এসেছেন। লালন সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করায় একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। পরবর্তীতে দুই সপ্তাহব্যাপী সাধুসঙ্গ করেন। লালন দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন। তারপর তিনি লালন দর্শনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। লালন দর্শন সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে চাইলে আমি তাকে বাংলা ভাষা শেখার কথা বলি।

জান্নাত বাংলা ভাষা শেখার পর তার সঙ্গে আমার ভাব-বিনিময় হয়। আমার দর্শনজ্ঞান ধীরে ধীরে তার মধ্যে দেয়া শুরু করি এবং এখন লালন শাহ-এর দেখানো পথের অনুসারী করি।

লালন সাধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফকির নহির শাহ হলেন দরবেশ লবান শাহ ওরফে আব্দুর রবশাহ-এর শিষ্য। গত ৪০ বছর ধরে লালন দর্শন নিয়ে রয়েছেন তিনি।

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহ-এর মাজারে মঙ্গলবার বসেছে সাধুর হাট। বাউল সম্রাটের ১২৮তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী আলোচনা, সংগীতানুষ্ঠান ও লালন মেলা।

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ স্লোগানে মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে শুরু হয়েছে এই লালন মেলা। বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের এমপি মাহবুব উল আলম হানিফ এই মেলার উদ্বোধন করেন।

আল-মামুন সাগর/এএম/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।