মনোনয়ন দৌড়ে আ.লীগ, বিএনপির চার হেভিওয়েট
যশোর-৩ (সদর) আসনের নির্বাচনে লড়াই হবে ‘হেভিওয়েট প্রার্থীদের’। কারণ দু’দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছে চার হেভিওয়েট। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনজন এবং বিএনপির একজন। এখানে নৌকার টিকিট প্রত্যাশী বর্তমান এমপি কাজী নাবিল আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটো।
আর বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। তবে শারীরিক অবস্থার কারণে তিনি নির্বাচন করতে না পারলে তার পরিবার থেকে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
যশোর সদরের ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে যশোর-৩ আসন গঠিত। ৯০ পরবর্তী ছয়টি সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দুই বার ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী চারবার নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের রওশন আলী, ১৯৭৯ সালে বিএনপির তরিকুল ইসলাম, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে খালেদুর রহমান টিটো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাসদের আবদুল হাই, ৯১ সালে আওয়ামী লীগের রওশন আলী, ৯৬’র ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির তরিকুল ইসলাম, ৯৬’র ১২ জুন আওয়ামী লীগের আলী রেজা রাজু, ২০০১ সালে বিএনপির তরিকুল ইসলাম, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের খালেদুর রহমান টিটো ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের কাজী নাবিল আহমেদ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে দলের কে মনোনয়ন পাচ্ছেন তা নিয়ে সবার মধ্যেই রয়েছে কৌতুহল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ থেকে কে হচ্ছেন নৌকার মাঝি তা নিয়ে মাঠের কর্মী ও সমর্থকদের প্রায়ই আলোচনা করতে শোনা যায়।
শহরের প্রাণ কেন্দ্র দড়াটানার একটি চায়ের দোকানের আড্ডায় শহরের রাজনীতি সচেতন কয়েকজন বললেন, সবারই কমবেশি জনপ্রিয়তা আছে। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে কর্মীরা তার সঙ্গেই থাকবে। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে কেউ বিদ্রোহী হবেন না বলে তারা মত দেন।
স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ২০০১ সালে যশোরে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া ‘চশমা লীগার’রা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এখনও দলীয় ফোরামে ওই উদাহরণটি সামনে আনা হয়। তাই মনোনয়ন পেতে যতই লবিং-গ্রপিং থাক না কেন ইলেভেন্থ আওয়ারে সবাই নৌকার পক্ষেই কাজ করবে বলে তার বিশ্বাস।
এদিকে, গত কয়েক বছর ধরে যশোর আওয়ামী লীগে চলছে মনোনয়ন কেন্দ্রীক রাজনীতি। মনোনয়ন পেতে সহযোগী সংগঠনের নেতাদের পাশে রাখাকে এখানে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। এ হিসেবে জেলা যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, যুবমহিলা লীগ, শ্রমিক লীগের সভাপতি-সম্পাদকরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে রয়েছেন। আর কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে আছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কিছু নেতা।
আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত খালেদুর রহমান টিটো দলে এখন সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। ২০০৮ এর নির্বাচনে তিনি নৌকার টিকিট পেয়ে এমপি হন। এরপর যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে তার বিরোধ হয়। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে দল তাকে মনোনয়ন না দিয়ে নতুন মুখ হিসেবে কাজী নাবিল আহমেদ’র হাতে নৌকা তুলে দেয়। শাহীন চাকলাদারও নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। বঞ্চিত শাহীনকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়নে জয়ী হন।
উপজেলা চেয়ারম্যান পদে শাহীন চাকলাদারের বিপক্ষে ভোট করেন খালেদুর রহমান টিটোর ছেলে মাশুক হাসান জয়। এতে শাহীনের সঙ্গে টিটো ও তার ছেলে জয়ের পূর্ব বিরোধ তীব্র হয়। আস্তে আস্তে রাজনীতির মাঠে চুপচাপ হয়ে যান টিটো পক্ষ। মাঠে চাঙ্গা হন শাহীন চাকলাদার ও এমপি হওয়া কাজী নাবিল।
দশম সংসদ নির্বাচনে কাজী নাবিল আহমেদ ফাঁকা মাঠে গোল দিলেও এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এবার সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই হিসেবে নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম হবে শক্তিশালী প্রার্থী। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী বাছাই করবে আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থী ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই চ্যালেঞ্জিং হবে। ফলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
এখানে স্থানীয় রাজনীতিতে শাহীন ও নাবিল গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। বিগত নির্বাচনে শাহীন চাকলাদারের নাম জোরেশোরে শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত নাবিল আহমেদ মনোনয়ন ছিনিয়ে আনেন। মনোনয়ন না পাওয়ায় চাকলাদার অনুসারীরা ক্ষোভও প্রকাশ করেন। তবে হাল ছাড়েননি শাহীন চাকলাদার।
শাহীন চাকলাদারের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ হাসান বিপু বলেন, সদরের ১৫টির মধ্যে ১২টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রসহ পুরো প্যানেল, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকার্মীরা সবাই শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে আছেন। ২০০৩ সালের পর থেকে শাহীন চাকলাদার দলকে সুসংগঠিত করায় এমনটি সম্ভব হয়েছে। তাই তৃণমূলের কর্মীরা শাহীন চাকলাদারকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার বলেন, গতবার এ আসনে ভোট হয়নি। নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন সেটি কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। এজন্য তৃণমূলের প্রতিনিধি নৌকার মনোনয়ন পাবেন। তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এবার মনোনয়ন পাবো বলে আশাবাদী।
ফের মনোনয়নের জন্য তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। আওয়ামী লীগের একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও মনোনয়ন ধরে রাখার জন্য তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
কাজী নাবিল আহমেদের কাছের লোক সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহতি কুমার নাথ বলেন, যশোর সদরে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, রাস্তা নির্মাণ হয়েছে। এমপি কাজী নাবিল আহমেদ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। মাদক ও সন্ত্রাসকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। এ জন্য কাজী নাবিল আহমেদ পুনরায় মনোনয়ন পাবেন এবং যশোর সদরের মানুষ তাকে ভোট দিয়ে জয়ী করবে।
অন্যদিকে এমপি খালেদুর রহমান টিটো বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নৌকার মনোনয়ন ধরে রাখতে পারেননি। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা খালেদুর রহমান টিটো। এ জন্য মাঝে মধ্যে শো-ডাউনও করছেন তিনি।
অপরদিকে, বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বরাবরই তিনিই বিএনপির প্রার্থী। তবে এবার তার শারীরিক অবস্থা খুব ভালো নয়। শেষ পর্যন্ত তিনি শারীরিক অসুস্থতায় প্রার্থী হতে না পারলে পরিবারেই প্রার্থী থাকবে বলে ধারণা তার অনুসারীদের। অর্থাৎ সদরের মনোনয়ন তরিকুল পরিবারেই থাকবে। সেক্ষেত্রে স্ত্রী জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য অধ্যাপিকা নার্গিস বেগমের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে ছেলে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতও বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন। তরিকুল পরিবারের বাইরে গেলে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাবেরুল হক সাবুও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী। তরিকুল ইসলাম প্রার্থী না হলেও সাবেরুল হক সাবু সদর আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হতে চান। সেই হিসেবে দলের অভ্যন্তরে নিজস্ব বলয়ও তৈরি করেছেন।
যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাবেরুল হক সাবু বলেন, আমরা মনে করছি তরিকুল ইসলামই প্রার্থী হবেন। তিনিই আমাদের অভিভাবক। তিনি নির্বাচন করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। যদি কোনো কারণে তিনি (তরিকুল) নির্বাচন না করেন, তাহলে তার আস্থাভাজন কর্মী হিসেবে তিনি আমার নাম প্রস্তাব করবেন বলে বিশ্বাস করি।
আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে যশোর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে মাহবুব আলম বাচ্চু ও জাহাঙ্গীর আলমের নাম শোনা যাচ্ছে। যদিও জেলা জাতীয় পার্টি তাদের প্রার্থী হিসেবে জাহাঙ্গীর আলমের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
মিলন রহমান/এমএএস/এমএস