সন্ত্রাসীদের দখলে বগুড়ার বালু ব্যবসা
প্রতি সিএফটি (স্কয়ার ফিট) বালু তুলতে খরচ পড়ে মাত্র তিন টাকা। প্রশাসনসহ স্থানীয় সন্ত্রাসী বাবদ খরচ আরো এক টাকা। চার টাকা সিএফটির বালু বিক্রি করা হয় ১২ থেকে ১৩ টাকায়। বিনিয়োগের তুলনায় লাভ দ্বিগুণের বেশি হওয়ায় বালু ব্যবসা এখন সন্ত্রাসীদের দখলে। পেশাদার ব্যবসায়ীরা বালুমহাল দখল করতে ব্যবহার করছেন সন্ত্রাসীদের।
বগুড়া শহরের অন্তত ৫০টি পয়েন্টে এভাবেই চলছে বালু উত্তোলন। জমি থেকে বালু তোলার কারণে বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ধ্বসের ঘটনাও ঘটছে। বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে খুনসহ অস্ত্রবাজির ঘটনা তো রয়েছেই।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, বগুড়া শহরের ৫০টি পয়েন্টে বালু ব্যবসায় নেতৃত্বদানকারীরা হলেন, পল্লীমঙ্গলে ফারুক, খালেক, মানিক, সালেক, আজাদ, মিজানুর; নওদাপাড়ায় নুর আলম ও আলম; জোরগাছায় ফজলু ও জুয়েল; গোবরধনপুরের বেলাল; খামারকান্দি মধ্য কাতালিতে দেলোয়ার ও স্বপন এবং মানিকচকে বাবলু, মতিন ও মিরাজ।
জানতে চাইলে জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি আলহাজ্ব শেখ জানান, যারা বালু তোলে এরা দলীয় পদধারী কেউ নয়। তবে মিছিল মিটিং এ তারা কোনো কোনো সময় হাজির হয়।
জানা গেছে, আগে বগুড়া শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় বালু উত্তোলন করা হতো মূলত করতোয়া ও বাঙালি নদীকে কেন্দ্র করে। এখন সেটা বর্ধিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় আবাদি জমির ওপর। এ কারণে শহরতলিতে আবাদি জমি লিজ দেয়ার প্রবণতাও বেড়ে গেছে। মাত্র এক শতাংশ জায়গা লিজ দেয়া হচ্ছে ৫০ থেকে এক লাখ টাকায়। এ অঞ্চলে কোনো বালুমহাল না থাকার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের একাধিক চক্র।
পুলিশের তথ্য অনুসারে, বিভিন্ন সময় বালু ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জের ধরে রাজাপুর এলাকায় আমিনুল ইসলাম দিপু নামের এক যুবদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করাকে কেন্দ্র করে খুন হন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল। মানিকচক এলাকার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সহযোগীসহ খুন হন রাইসুল। সদর উপজেলার ভাটকান্দি গ্রামে খুন হন শাহিন প্রামানিক নামে এক বালু ব্যবসায়ী। এছাড়া আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য মেলার সামনে বালু তোলাকে কেন্দ্র করে খুন হন আওয়ামী লীগ কর্মী শফিক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সহযোগিতায় বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে দিনরাত বালু উঠছে। মেশিন দিয়ে ড্রেজিং এর মাধ্যমে বালু তোলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শতশত একর আবাদি জমি ও নদীর তীর সংলগ্ন ঘর-বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অনেক এলাকায় ভূমি ধসের কারণে রাস্তাঘাট দেবে গেছে। এলাকাবাসীর বাধা এবং জেলা প্রশাসনের তৎপরতা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সরাসরি হস্তক্ষেপে চলছে এই বালু বাণিজ্য।
ভান্ডারবাড়ি গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান পান্না তালুকদার জানান, অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে ভাঙনে তার বাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। একই কথা বলেছেন আপেল মাহমুদ ও ভুতবাড়ি গ্রামের মজিবর রহমান। তারা জানান, একদিন সকালে জমিতে গিয়ে দেখেন মাঝখানে ধস নেমেছে।
এ সকল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নৌকার উপর শ্যালো মেশিন তুলে নদীর গভীর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ভাসমান অবস্থায় বালু তোলা হচ্ছে। এছাড়া নদীর বুকে জেগে ওঠা চর থেকে বালু কেটে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ওই বালু আশেপাশের এলাকায় বিক্রি করা হচ্ছে উচ্চ দামে।
যমুনা নদীর শহড়াবাড়ি ঘাট এলাকা থেকে পুকুরিয়া গ্রাম পর্যন্ত ৫টি পয়েন্টে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু উত্তোলকারীরা হলেন, গোলাম রব্বানী, আব্দুস সালাম, সুজন, শহিদুল হক ও এনামুল হক। এরা বলেছেন, বালু তুলছেন যুবলীগ নেতা জিলানীর নির্দেশে।
তবে অভিযোগের ব্যাপারে জিলানী হোসেন জানান, আমি নিজে মেশিন ভাড়া দিই না। ঠিকাদারি কাজসহ অন্য কোনো কাজে বালুর দরকার হলে তখন উত্তোলন করে থাকি। আর আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ বালু তুলে থাকলে সে ব্যাপারে আমি অবগত নই।
ইছামতি নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে ধুনট-কাজিপুর সড়কের অনেক স্থানে ধস নেমেছে। একইভাবে ধস নেমেছে আশেপাশের অনেক জমিতে।
ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, অভিযোগ এসেছে অনেক। এদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
একই অবস্থা বগুড়া শহরের অভ্যন্তরে করতোয়া নদীর। শহরের মালতিনগর, ভাটকান্দি, শ্মসানঘাট এলাকায় নদীর মাঝ থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু উঠছে দিনরাত। এলাকার চিহ্নিত ব্যবসায়ীরা বালু তুলছে শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রফি নেওয়াজ খান রবিনের নির্দেশে। বালু তুলে তা প্রতি ট্রাক বিক্রি করা হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১১শ টাকায়।
ভাটকান্দি এলাকার বাসিন্দা মোতালেব ফকির জানান, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হওয়ার কারণে ভয়ে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু তাদের এলাকার জমি, রাস্তাঘাট দেবে যাচ্ছে। তবে অভিযোগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা রফি নেওয়াজ খান রবিন জানান, তিনি ৭ বছর আগে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এখন এসবের সঙ্গে নেই। তার নাম ভাঙিয়ে এ সকল কাজ করা হচ্ছে।
এদিকে কাহালু, দুপচাঁচিয়া, শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া নাগর নদীর মাইলের পর মাইল দখল করে রেখেছে ইটভাটা মালিক ও বালু দস্যুরা। বছরের পর ইট তৈরির জন্য মাটিকাটা এবং বালু উত্তোলনের ফলে এই উপজেলার কমপক্ষে ৫০টি গ্রামে ভুমি ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রশাসন এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করেই নদী থেকে মাটি কাটা ও বালু তোলা হয় বলে অভিযোগ করেছেন কাহালু বাজার এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল সবুর। অপর ব্যবসায়ী ফিরোজ হোসেন জানান, আটালিয়া, যোগারপাড়া, কাশিমালা, জাঙ্গালপাড়া, ফকিরপাড়া, কালাই থিয়টপাড়া, নলডুবি, ভুগোইল, কালিতলা, তালোড়া, ধানপূজা, পিঁপড়া এলাকায় নাগর নদীর শতাধিক পয়েন্ট থেকে শালো মেশিন, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এবং ইট ভাটা মালিকেরা ট্রাকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
দুপচাঁচিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেদ পারভেজ জানান, এ চক্রটি পরিবেশের ক্ষতি করছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব ফজলুল হক জানান, তার দলের কেউ জড়িত নেই। থাকলে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নদীতে মেশিন বসিয়ে বালু উত্তলোনকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর আখ্যায়িত করেছেন রাজশাহী বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক নাজমুল হক। তিনি জানান, কোনো স্থানকে বালু মহাল ঘোষণা করা হলে তাদের কাছে থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু গত এক বছরের মধ্যে পরিবেশ অধিদফতর থেকে কাউকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। আর বগুড়াতে বালুমহাল হবার মতো তেমন কোনো নদী নেই। এ কারণে বালু তোলা হচ্ছে অবৈধভাবে। এতে করে পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
এসএস/পিআর