ধর্ষণচেষ্টার মামলা চাপা দিতে নাশকতার মামলা!

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশহী
প্রকাশিত: ০১:৩৯ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮
প্রতীকী ছবি

রাজশাহীতে ছাত্রী অপহরণ ও ধর্ষণচেষ্টা মামলা চাপা দিতে ছাত্রীর বাবা ও চাচার নামে নাশকতার দুটি সাজানো মামলা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় কাটাখালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদি হাসানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ বাদী হয়ে নগরীর কাটাখালি থানায় মামলা দুটি করে। বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের দুটি মামলার এজাহারে নাম রয়েছে অপহরণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার ছাত্রীর বাবাসহ ১৩ জনের। অপহরণ ও ধর্ষক চক্রের যোগসাজশে মামলা দুটি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে বিষয়টি জানাজানি হলে রাজশাহী নগর পুলিশে শুরু হয় তোলপাড়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার প্রত্যাহার করা হয় কাটাখালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদি হাসানকে। তবে মামলার বাদী ওই থানার এসআই (নিরস্ত্র) আবদুল হাকিম সরকার এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, নগরীর উপকণ্ঠ মহানগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম ইনিস্টিটিউটের অধ্যক্ষ জহুরুল আলম রিপনের যোগসাজশে মামলা দুটি দায়ের করে পুলিশ।

এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি নিজ অফিস কক্ষেই এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে রিপন। বিষয়টি জানাজানি হলে পরদিন থেকেই শাস্তি দাবিতে বিক্ষোভে নামে এলাকাবাসী। এরপর একে একে অধ্যক্ষের কুকর্ম ফাঁস হতে শুরু করে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওই ছাত্রীসহ আরও দুই ছাত্রী এবং এক শিক্ষিকা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর নীপিড়নের লিখিত অভিযোগ দেন। এছাড়া আর্থিক অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরাও।

পরে অপহরণ ও ধষর্ণচেষ্টার অভিযোগে একমাস পর ৮ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই এক ছাত্রী। ওই দিনই জেলার পবা উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন তাকে জেলহাজতে পাঠায়। জামিনে এখন এলাকায় রয়েছেন অধ্যক্ষ।

এরপর ১৩ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভায় অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

অপরদিকে ওই ছাত্রীর বাবা জানিয়েছেন, জামিনে বেরিয়ে আসার পর থেকেই অধ্যক্ষ মামলা তুলে নিতে তাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন। এমকি জটিল মামলায় ফাঁসানোর হুমকিও দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নাশকতার দুটি মামলায় তাদের নাম দেয়া হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে ন্যায় বিচার দাবি করেন ওই ছাত্রীর বাবা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাটাখালি থানার এসআই (নিরস্ত্র) আবদুল হাকিম সরকার বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। ৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে মামলা দুটি নথিভুক্ত হয়। মামলার নম্বর ১০ ও ১১। মামলা দুটিরই তদন্ত ভার দেয়া হয়েছে থানার আরেক উপপরিদর্শক রবিউল ইসলামকে।

দুটি মামলার এজাহার অভিন্ন। দুই মামলাতেই ওই ছাত্রীর বাবাকে ৬ নম্বর এবং চাচাকে ৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে। বাকি আসামিরাও আশপাশের এলাকার বাসিন্দা।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, আসামিরা একেবারেই সাধারণ মানুষ। অথচ পুলিশ বলছে তারা বিএনপির নেতাকর্মী।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, নাশকতার গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে ৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ৫ মিনিটে বেলঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে পৌঁছায় পুলিশের টহল দল। ওই সময় আগে থেকে অবস্থান নেয়া বিএনপির সশস্ত্র নেতাকর্মীরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়।

পরে পুলিশ সেখান থেকে তিনটি অবিস্ফোরিত ককটেল, তিনটি টিনের কৌটার অবিস্ফোরিত অংশ, লোহার তারকাটা ১০ পিস, কাঁচের ভাঙা অংশ ৫ পিস, বিস্ফোরিত বোমার স্কেচটেপের ৯টি ছেঁড়া অংশ এবং সাইকেলের বিয়ারিং এর ৭ পিস বল উদ্ধার করে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটানাস্থলের আশেপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে সেদিনের ঘটনা নিয়ে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, এজাহারে বর্ণিত ঘটনা মনগড়া। সেদিন এমন কিছুই সেখানে ঘটেনি।

দুই মামলায় সাক্ষী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বেলঘরিয়া পশ্চিমপাড়ার রহিম উদ্দিন মন্ডলের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন মিঠু (৩৫) এবং ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বেলঘরিয়া মধ্যপাড়ার আব্দুল আজিজের ছেলে রানাউল ইসলাম টোটন (৩৫)।

বেলঘরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ইউসুফপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম রতনের চেম্বারে কথা হয় মামলার ২ নম্বর সাক্ষী রানাউল ইসলাম টোটনের সঙ্গে।

চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতেই তিনি বলেন, এজাহারে বর্ণিত এমন ঘটনা সেদিন ঘটেনি। ওই সময় তিনি বিদ্যালয়ের পাশেই ছিলেন।

থানার উপপরিদর্শক আবদুল হাকিম সরকার তাকে মোবাইলে সাজ্জাদ হোসেন মিঠুর ওষুধের দোকানে ডেকে নেন। পরে সেখানেই সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয় তার।

ওই সময় ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, কৌশলগত মামলায় তাদের সাক্ষ্য দিতে হবে। রাজনৈতিক কারণে তাতে রাজি হয়ে যান তিনি।

তবে পরে মামলার এজাহার পড়ে অবাক হন রানাউল ইসলাম টিটন। আসামিদের কাউকে তিনি চেনেন না বলেও দাবি করেন।

বিদ্যালয় এলাকার ব্রিজ মোড়ের আরেক সাক্ষী সাজ্জাদ হোসেন মিঠুর ওষুধের দোকান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দোকানটি বন্ধ পাওয়া যায়। সেখানকার অন্য দোকানীরা জানান, মিঠু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সেখানে দায়িত্বপালন শেষে সন্ধ্যায় দোকানে সময় দেন। কয়েক দফা চেষ্টা করেও মুঠোফোনে সংযোগ না পাওয়ায় মিঠুর মন্তব্য মেলেনি।

জানতে চাইলে চেয়ারম্যান শফিকুল আলম রতন বলেন, এলাকায় এমন ঘটনার খবর তার কাছেও নেই। পুলিশও তাকে বিষয়টি জানায়নি। ঘটনা ঘটে থাকলে তিনি অবশ্যই জানতেন।

ওই ছাত্রীর বাবা ও চাচা আসামি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নগরীর কাটাখালি পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হযরত আলী। তিনি বলেন, তাদের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। ছাত্রীর দাদা পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন দুই বছর। ওই পদে থেকেই তিনি ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মারা যান। ছাত্রীর বাবা ও চাচা আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। তাদের নাশকতার মামলায় জড়ানো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এ বিষয়ে কাটাখালি পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, কাপাসিয়া মৃধাপাড়া মোড়ে ওই ছাত্রীর বাবার মুদিখানার দোকান রয়েছে। একেবারেই সাদাসিদে জীবনযাপন করেন তিনি। অতীতে তার এবং তার পরিবারের নামে নাশকতার কোনো অভিযোগ নেই। বানোয়াট মামলায় তাদের ফাঁসানো হয়েছে।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী এসআই আবদুল হাকিম সরকার গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। তবে থানার ওসি মেহেদি হাসান দাবি করেছেন, এমন ঘটনা ঘটেছে বলেই মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। কিন্তু ওই ছাত্রীর বাবা ও চাচার নাম এজাহারে আসলো কি করে তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

জানতে চাইলে নগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম বলেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তদন্ত শেষে আইনত ব্যবস্থা নেয়া হবে। থানার ওসি মেহেদি হাসানকে প্রত্যাহারের বিষয়টিও নিশ্চিত করেন এই নগর পুলিশ কর্মকর্তা।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।