নওগাঁর সাংবাদিকদের গর্ব শেখ আনোয়ার হোসেন
ব্যক্তি জীবনে সার্থক ও সফল বলতে যাকে বোঝায় তিনি হলেন শেখ আনোয়ার হোসেন। একাধারে পারিবারিক, সাংবাদিকতা, আইন পেশা ও সমাজসেবায় তিনি একজন সফল ব্যক্তি। সর্বোপরি তিনি একজন সহজ-সরল ও সৎ মানুষ। সাংবাদিকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব, সততা ও সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা অন্যদের চেয়ে তাকে আলাদা করেছে।
আনোয়ার হোসেনের দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে একটি নিউজ মনে রাখার মতো। ‘নওগাঁয় আজ ফতোয়াবাজদের সালিসে ভাগ্য নির্ধারণ হবে গৃহবধূ সাহিদার’ শিরোনামে ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর (শনিবার) ‘দৈনিক বাংলাবাজার’ পত্রিকায় নিউজটি প্রকাশ হয়। এরপর শুরু হয় দেশজুড়ে তোলপাড়।
নওগাঁ সদর উপজেলার আতিথা গ্রামের মোস্তফার ছেলে সাইফুলের সঙ্গে জেলার মহাদেবপুর উপজেলার শরিজপুর গ্রামের সাহিদার বিয়ে হয়। তাদের ১০ মাস বয়সী এক কন্যা সন্তান ছিল। সংসার করার এক পর্যায়ে পারিবারিক কলহে স্বামী সাইফুল স্ত্রীকে মৌখিক তালাক দেয়। পরবর্তীতে রাগ ভেঙে গেলে তারা আবারও স্বাভাবিকভাবে সংসার করতে থাকে। কিন্তু বাঁধ সাজে একই পরিবারের হাজী আজিজুল হক। তিনি ফতোয়া দেন (হিল্লা বিয়ে) সাহিদাকে তালাক দিয়ে অনত্র বিয়ে দিতে হবে। নইলে পাপ হবে। সেই স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে পুনরায় সাইফুলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসার করতে হবে।
সাহিদাকে জোরপূর্বক রাজি করিয়ে নামমাত্র সাইফুলের চাচাতো ভাই সামছুলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তার ঘরে তুলে দেয়া হয়। দু’দিন পর তার কাছ থেকে তালাক নিয়ে কৌশলে সাহিদাকে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং জানানো হয় আগামী ২/৩ মাস পর আবারও সাইফুলের সঙ্গে বিয়ে হবে। কিন্তু সাইফুলের পরিবার থেকে জানিয়ে দেয়া হয় সাহিদার সঙ্গে আর সংসার না।
এমন ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে নিউজ করেন শেখ আনোয়ার হোসেন। ‘দৈনিক বাংলাবাজার’ পত্রিকায় পরদিন ২ ডিসেম্বর নিউজটি প্রকাশ হয়। এ নিয়ে এলাকায় হৈ চৈ পড়ে যায়। এ ঘটনার পর ওই গৃহবধূর বাবার বাড়িতে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছিল সেদিন।
এ নিউজের প্রেক্ষিতে সেদিনই মহামান্য হাইকোর্টে বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি রুল জারি হয়। সেখানে বলা হয় গ্রামে যেন কোনো সালিস না বসে এবং ফতোয়াবাজদের আটক করতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে এ নির্দেশ দেয়া হয়। এতে ফতোয়াবাজদের সালিস পণ্ড হয়ে যায় এবং বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়।
এরপর মহামান্য হাইকোর্টে একটি রায় ঘোষণা করা হয় সকল প্রকার ফতোয়া বন্ধ। রায় ঘোষণার পর দেশে মৌলবাদীরা আন্দোলন শুরু করে। দেশে তখন উত্তপ্ত অবস্থা। শেখ আনোয়ার হোসেনকে মৌলবাদীরা বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি প্রদান করে। এরপর রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মৌলবাদীরা আপিল করে। আপিল করা হলে ফতোয়া বন্ধের রায় স্থগিত রাখা হয়। এতে আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যায়।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বাবা মরহুম শেখ আবদুল আজিজ ছিলেন একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা। মা আছিয়া বেগম একজন গৃহিনী। ১৯৫১ সালে ৭ জানুয়ারি নওগাঁ শহরের চকদেবপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ আনোয়ার হোসেন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় তিনি। বাবার চাকরির সুবাদের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করতে হয়েছে। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ী মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৯ সালে রাজবাড়ী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং ১৯৭৫ সালে আইন বিষয়ে (এলএলবি) মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি গল্প ও কবিতা লিখতেন। সাংসারিক জীবনে তিনি এক সন্তানের জনক। ছেলে শেখ আদিত আজিজ বুয়েট তৃতীয় বর্ষে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন।
সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য এরশাদ সরকারের আমলে ‘চকদেব জনকল্যাণ সংস্থা’ প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া নওগাঁ ডায়াবেটিক সমিতি, রেড ক্রিসেন্ট ও আইন কলেজ এর প্রতিষ্ঠা। এছাড়া বিভিন্ন মানবাধিকারের সঙ্গেও সম্পৃক্ত আছেন। ১৯৭৫ সালে আইন বিষয়ে মাস্টার্স পাসের পর ১৯৯৬ সালে নওগাঁ বারে প্র্যাকটিস শুরু করেন। সেখানে দীর্ঘদিন সহযোগী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ছিলেন।
শেখ আনোয়ার হোসেন তার কর্মময় জীবন নিয়ে বলেন, ১৯৭৮ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করি। এরপর ১৯৮৪ সালে ‘দৈনিক বাংলাবাজার’ পত্রিকায় নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি এবং ‘বাংলাদেশ বেতার’ এ নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করি।
বর্তমানে ‘বাংলাদেশ বেতার’ এ তিনি কাজ করছেন। সাংবাদিকতাকে তিনি কখনই পেশা হিসেবে নেননি। শখের বসেই এ কাজটি করে যাচ্ছেন। এ কাজের মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত মানুষদের কথা তুলে ধরা যায়।
তিনি বলেন, একটি নিউজে জীবনের স্বার্থকতা ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আর সেটি হচ্ছে ফতোয়া (হিল্লা বিয়ে)। ফতোয়াবাজদের নিয়ে নিউজটি প্রকাশ হওয়ার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। আর নিউজটি প্রকাশ হওয়ার পর মৌলবাদীরা বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়। এমনকি প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়া হয়েছিল। এরপর প্রায় চারমাস আত্মগোপনে থাকতে হয়েছিল। এক সময় মনে করেছিলাম হয়ত দেশে আর থাকা হবে না। বিদেশে পাড়ি জমাতে হবে। মাস কয়েক পর সরকার পরিবর্তন হলে (আ.লীগ ক্ষমতায় আসে) সবকিছু শান্ত হয়ে যায়। ওই নিউজের প্রেক্ষিতে ২০০১ সালে আমাকে ঢাকায় জাতীয়ভাবে ‘নূরজাহান স্মৃতি পুরস্কার-২০০০’ দেয়া হয়।
শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের যা হবার হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে কিছু বলার নাই। তবে ভবিষ্যৎ নতুন প্রজন্মের জন্য দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। কেন না, তরুণরাই একদিন সমাজের দায়িত্ব নেবে। তরুণরা ঐক্যবদ্ধ হলে অসাধ্য কাজও সাধন হয়। সাংবাদিকদের লেখনির মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিতে হবে। সাংবাদিকদের লেখনি সমাজের আয়নায় পরিণত হোক। লেখা পড়ে মানুষ ভালো কিছু শিখবেন। যা দেখে মানুষ সচেতন হবে। উৎসাহিত হবেন। ভালো কাজ করতে অনুপ্রেরণা পাবেন।
আমার হাত ধরেই সাংবাদিকতা জগতে বেশ কয়েকজনের বিচরণ ঘটেছে। তারা এখন নিজ নিজ জায়গায় খ্যাতি ছড়িয়েছেন।
নওগাঁ জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি কায়েস উদ্দিন বলেন, ব্যক্তি জীবনে তিনি খুবই ভালো মনের মানুষ। তিনি একজন সৎ ও নিষ্ঠা সাংবাদিক। তার কর্মময় জীবন ছিল খুবই সুন্দর।
নওগাঁ/এমএএস/এমএস