আগামী মৌসুমে হারিয়ে যাবে কুয়াকাটার ঐতিহ্য
পর্যটননগরী কুয়াকাটার সৌন্দর্যমণ্ডিত নারিকেল বাগানের পর এবার বিলুপ্তির পথে ‘কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান’। পর্যটকদের বিনোদন কেন্দ্র জাতীয় উদ্যানের অন্যতম আকর্ষণ ঝাউ বাগানের ৭০ শতাংশ চলতি বর্ষা মৌসুমে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
আগামী মৌসুমে বাকি অংশটুকু সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢেউয়ের তোড়ে ঝাউ বাগানের শত শত গাছ উপড়ে পড়ে আছে সমুদ্রসৈকতে। ফলে বিলুপ্তির পথে রয়েছে কুয়াকাটার ঐতিহ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পর্যটকদের বিনোদন কেন্দ্র কুয়াকাটার জাতীয় উদ্যান দাঁড়িয়ে আছে শুধু নাম নিয়ে। সৌন্দর্যমণ্ডিত উদ্যানটি প্রকৃতির ভয়াল থাবায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে বিশাল বিশাল ঢেউ লাড়ছে কূলে। প্রচণ্ড ঢেউয়ে জাতীয় উদ্যানের ঝাউ বাগানের অসংখ্য গাছ সমুদ্রসৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ফলে মোটরসাইকেলে ঘুরতে আসা পর্যটকরা সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন।
বিশেষ করে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়ার পথে পর্যটকরা প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছেন। ভোররাতে গঙ্গামতি যাওয়ার পথে সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঝাউ গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এরপরও গাছগুলো সরানো কিংবা জাতীয় উদ্যানটি রক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এদিকে, নজরকাড়া আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন লেকটি পরিণত হয়েছে কচুরিপানায় বদ্ধ জলাশয়ে। চারদিকের বর্ণিল পাতাবাহার গাছগুলো নেই। পরিণত হয়েছে জঙ্গলে। লেকটির মাঝখানের কাঠের ব্রিজটি ভাঙাচোরা কঙ্কালের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। ছয়টি প্যাডেল বোটের হদিস নেই। বাঁধানো ঘাটগুলোতে পড়েছে শেওলার আস্তরণ। পিকনিক স্পটের টিনের ছাউনির ঘরগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আবর্জনায় ভর্তি। লেকটি ভ্রমণের মূল সড়কটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। পর্যটকরা এখন এই পথ দিয়ে হাঁটে না।
কুয়াকাটা পর্যটন এলাকার সবচেয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত স্পট ছিল জাতীয় উদ্যানটি। যা এখন ধ্বংসের শেষপ্রান্তে। সিডর-আইলার মতো সাইক্লোন কিংবা মহাসেনের মতো জলোচ্ছ্বাসে কয়েক দফায় বিধ্বস্ত হয়েছে। এরপরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা এখানে যান। কিন্তু আগের সেই দৃশ্যগুলো না দেখে হতাশ হন পর্যটকরা।
কুয়াকাটা জিরোপয়েন্ট থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে সৈকত লাগোয়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। চারদিকে ঝাউ বাগানে ঘেরা ছিল। মাঝে মাঝে দেয়া ছিল বিশ্রামের জন্য বেঞ্চ। ইকোপার্কটি বাইরে থেকে গহীন অরণ্য মনে হলেও মাঝখান দিয়ে একাধিক চলার পথ ছিল। ছিল ছোট ছোট বক্স কালভার্ট। এরই মধ্যে বিশাল লেক। লেকের মাঝখান দিয়ে চলাচলের জন্য ছিল একটি কাঠের ব্রিজ। লেকের দুই পাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির বনজ, ফলজ, সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছ ছিল। স্বচ্ছ টলমলে পানির মধ্যে বনবিভাগের ফাইবার প্যাডেল বোট ছিল। বোটের মধ্যে সপরিবারে ঘোরার সুযোগ ছিল। ইচ্ছা করলে পিকনিক পার্টির বহর ব্যবহার করত উদ্যানের এরিয়া। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটককে উদ্যানটি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত। পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াত সবাই। প্রায় ৫ বছর আগে কুয়াকাটা ইকোপার্ক ও ফাতড়ার বনাঞ্চল এলাকা জাতীয় উদ্যানের আওতায় ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে যেন কিছুই নেই। বিদ্যুৎ লাইন খুঁটিসহ সব লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে আছে। শুধু একটি গেটে লেখা রয়েছে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পর্যটনশিল্প বিকাশের লক্ষ্যে কুয়াকাটায় জাতীয় উদ্যান করা হয়। যার মধ্যে কুয়াকাটার ইকোপার্ক ছাড়াও রয়েছে ফাতড়ার বিশাল বনাঞ্চল। প্রায় ১৮ হাজার একর এলাকা নিয়ে উদ্যানের অবস্থান। বনাঞ্চল ছাড়াও বিশাল বনভূমি ইকোপার্কের এরিয়ায় রয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদফতরের উদ্যোগে প্রাথমিক পর্যায়ে দুই কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করা হয়। ওই সময়ে প্রধান ফটক নির্মাণ, মেঠোপথ প্রশস্তকরণ, বক্স ও পাইপ কালভার্ট, ভূমির উন্নয়ন, গোলঘর ও জেটি নির্মাণ, ফিডার রোড, কার পার্কিং সুবিধা, পিকনিক স্পট, টিকিট কাউন্টার, অ্যাপ্রোচরোড, বিশুদ্ধ পানির সংস্থান, অভ্যন্তরীণ পানি সরবরাহ, সিটিং বেঞ্চ ও লেক-পুকুর খনন করা হয়।
এছাড়া প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইকোপার্ক এলাকায় ম্যানগ্রোভ ও ননম্যানগ্রোভ এবং শোভাবর্ধনকারী বাগান ও বন্যপ্রাণির আবাসস্থল উন্নয়নের কাজ করা হয়। বাগান সৃজনে ৪৭ হেক্টর বাগানে নারিকেল, ঝাউ, আমলকি, অর্জুন, জারুল, হিজল, চালিতা, পেয়ারা, জাম, হরিতকি, কাঠবাদাম, মহুয়া, কামিনি, লালকরমচা, পলাশসহ বিভিন্ন প্রজাতির লক্ষাধিক গাছের চারা রোপণ করা হয়। এর বাইরে এক হাজার ৬৬৭টি নারিকেল চারাও লাগানো হয়।
কিন্তু এসবের ৭০ শতাংশ নেই। বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের তাণ্ডবে ইকোপার্ক সংলগ্ন নারিকেল বাগান, ঝাউ বনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ইতোমধ্যে সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু মূল ফটকে একটি গেট রয়েছে। অরক্ষিত একটি বাউন্ডারি রয়েছে। গেটে কোনো নিরাপত্তারক্ষী নেই। ভেতরে একটি পাকা টংঘর তালাবদ্ধ রয়েছে। দেখে যেন মনে হচ্ছে মরে যাচ্ছে কুয়াকাটা।
কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে আসা হালিম, আনোয়ার, তুহিন, আরিফ, আফরোজা, শায়লা, জেসমিনসহ একাধিক পর্যটক জানান, ইকোপার্কের কাঠের ব্রিজগুলো একেবারেই ভাঙাচোরা। একটু বৃষ্টি হলে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যায়। চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটে। ঝাউ বাগান প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন শুধু নামে কুয়াটাকা, বাকি সব বিলীন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনবিভাগের এক বিট কর্মকর্তা বলেন, সাগরের শাসন না থাকায় প্রাকৃতিক কারণে ঢেউয়ের তাণ্ডবে সৈকতের বালু সরে বিভিন্ন গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক গাছ সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। কিছু গাছ উপড়ে পড়ে আছে। সেই গাছগুলো সৈকত থেকে সরানো হয়নি। তাই লন্ডভন্ড দেখাচ্ছে সৈকত।
এ বিষয়ে বনবিভাগের মহিপুর রেঞ্জ অফিসের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, জাতীয় উদ্যানের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গাছগুলো আগামী সপ্তাহে সরানো হবে। এগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে সরানো হয়নি। কারণ ঢেউয়ের প্রাথমিক চাপটা এই গাছগুলো ঠেকিয়ে দেয়।
এএম/পিআর