নতুন বাংলায় আশায় বুক বেঁধেছেন শাহানাজ


প্রকাশিত: ০৯:৩২ এএম, ১০ আগস্ট ২০১৫

ছোটবেলা থেকে বাবা আমাকে মিথ্যা পরিচয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন কিছু বুঝতাম না। স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছি এটাতেই খুশি ছিলাম। মাধ্যমিকে উঠে বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। গত ৩১ আগাস্ট রাত ১২টা ১ মিনিটের আগেও আমি ছিলাম ছিটমহলের বাসিন্দা। তাই ভারতীয় বলতো অনেকেই। কিন্তু এখন আমি বাংলাদেশি। কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ১১৯নং ছিটমহলের বাঁশকাটা এলাকার মাস্টার্স পড়ুয়া শাহনাজ পারভীন।

তিনি আরো বলেন, আমাকে আর পরিচয় নিয়ে কখনো বিব্রতবোধ করতে হবে না। স্কুলে পড়ার সময় কেউ ছিটের মেয়ে বললেও তেমন একটা লজ্জা লাগতো না। ছিটটা কী সেটাই বুঝতাম না। পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। কিন্তু মাধ্যমিকে গিয়ে মিথ্যে পরিচয়ে পড়ালেখা করার লজ্জাটা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জীবনকে অনেকটাই দুর্বিষহ ,মনে হচ্ছিল। এমনও মনে হয়েছিল পড়াশুনা করে কী হবে? কিন্তু স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে বড় হওয়ার। তাই পড়াশোনা ছেড়ে থাকতে পারিনি।

বাবা আব্দুস সাত্তার আর মা মেরিনা বেগম এতদিন ছিটের বাসিন্দা হলেও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করাতে সাহস যুগিয়েছেন সবসময়।

তাই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতেই নিজের ঠিকানা গোপন করে মিথ্যা পরিচয়ে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, পরে রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজ থেকেই সম্মান ডিগ্রি লাভ করনি শাহনাজ পারভীন। বর্তমানে ওই কলেজের মাস্টার্সে পড়ছেন তিনি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ডিগ্রি নেয়া শাহনাজ পারভীন রাষ্ট্র এবং নাগরিক বিষয়টি খুব ভালো করেই জানেন ও বোঝেন। এজন্য `ছিটমহল` শব্দটি তাকে এতদিন বার বার বিচলিত করে তুলেছিল। তাই রাষ্ট্রহীন ওই ভূখণ্ডে জন্ম নেয়া শাহনাজ তার জীবনে ভাবনার অতল সাগরে ডুবেছিলেন। ছিটের অধিবাসী হওয়ার কারণে জীবনে চলার পথে বার বার বঞ্চিত হতে হয় বলে জানান তিনি।

চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে গিয়ে অনেকটা বিষন্ন মনেই উত্তর দেন শাহানাজ পারভীন। একে একে পাঁচবার লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরিবারের অবলম্বন হিসেবে চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়েছি। মৌখিক পরীক্ষা শেষে চুড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায় কোথাও আমার নাম ও রোলটি নাই।

মৌখিক পরীক্ষায় কী যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি এমন প্রশ্নে পারভীন বলেন, অবশ্যই দেয়ার চেষ্টা করেছি। প্রায় সব প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিয়েছি। এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানান, আমরাতো তখন ছিটের মানুষ ছিলাম। আমাদের চাকরির জন্য সুপারিশ করার লোক না থাকাটাই স্বাভাবিক।


শাহনাজের বাবা আব্দুস সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে শাহনাজ তৃতীয়। সবাই পড়াশোনা করেছে আর বিয়ে দিয়েছি এক মেয়ের। ছিটের বাসিন্দা হওয়ায় এতদিন পার্শ্ববর্তী গ্রাম মোমিনপুরের ঠিকানা ব্যবহার করেই ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানো হয়। ওই ঠিকানায় বড় ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি করছে। শাহানাজ যেমন মাস্টার্সে পড়ছে তেমনি ছোট মেয়ে ঈশিতা পাটগ্রাম টিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স পাশ করে শাহানাজ। পাঁচবার সরকারি চাকরির লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেও চাকরি জোটেনি বলে জানালেন বাবা আব্দুস ছাত্তার।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা প্রশিক্ষণার্থী নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে শাহনাজ। সেখানেও বরাবরের ন্যায় লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে গত ১ জুলাই মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। এখন তো আমি বাংলাদেশি, তাই এবার কি আমার চাকরিটা হবে?

শাহানাজ পারভীনের মতো বিলুপ্ত ছিটের অসংখ্য ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করছে। তারা এখন বাংলাদেশি এটা সত্যি। কিন্তু নতুন বাংলাদেশি হয়ে শাহানাজের চাকরিতে কি কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে? পরিবারের অবলম্বন হিসেবে শেষ পর্যন্ত চাকরিটা জুটবে নাকি অধরাই থেকে যাবে এমন শঙ্কা যেন কিছুতেই কাটছে না শানানাজ পারভীনদের।

এদিকে পাটগ্রামের বিলুপ্ত ১১৯নং বাঁশকাটা ছিটমহল এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান খান। তিনি অবশ্য সেদিন শাহনাজের বার বার পরীক্ষা দিয়েও চাকরি না পাওয়ার বিষয়টি শুনেছেন। পরে সাংবাদিকদের সামনে ছিটবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আপনারা পড়াশোনা করেছেন, এটা সত্যিই গর্বের বিষয়। তাই দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে বঞ্চিত ছিটবাসীদের জন্য চাকরির ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিশেষ কোটা চাইবো আমি।

শাহানাজ পারভীন জানান, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান খানের কথাগুলো আমার মনে আশা জাগায়। এবার যদি সত্যি সরকার আমাদেরকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন তাহলে দেশের উন্নয়নে আমরাও অংশীদার হতে পারবো।

এমজেড/এমআরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।