যেসব কারণে নিজ দেশ ফেলে ভারতে যাচ্ছেন রোগীরা

রিপন দে
রিপন দে রিপন দে মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: ০৬:৪০ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০১৮

গ্রাম পর্যায়ে চিকিৎসা কিছুটা উন্নত হলেও জটিল রোগের ক্ষেত্রে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ জন্য দিন দিন সীমান্তের ইমিগ্রেশনগুলোতে রোগীদের লাইন বেড়েই চলছে। জটিল কোনো রোগ হলেই চিকিৎসার জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ছুটছেন আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল মানুষগুলো।

রোগী ও তাদের স্বজনরা দেশের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, সঠিক রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থতা, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, অযথা রোগ নির্ণয় পরীক্ষার পরামর্শ ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার উচ্চমূল্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। তারা জানান, এসব কারণেই দেশে চিকিৎসা নেন না অনেক রোগী।

জানা গেছে, বিদেশগামী রোগীদের ৮০ শতাংশই যান ভারতে। অন্যরা যান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে। তাদের মধ্যে অনেকেই ভ্রমণ ভিসা নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান।

তথ্য মতে, ২০১৭ সালে মোট দুই লাখ ২১ হাজার ৭৫১ জন বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ভিসা নিয়ে ভারত গেছেন। বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি। কারণ যারা ভ্রমণ ভিসা নিচ্ছেন তাদের ৩০ ভাগ ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক তথ্য মতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা ৯ লাখ। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ইমিগ্রেশন পুলিশের মতে, শুধু বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই প্রতিদিন যত মানুষ চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে তার পরিমাণ বছর শেষে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া দেশের জন্য তাদের জন্য গৌরবের বিষয় নয়। কিন্তু জীবন বাঁচাতে হবে তাই তারা যাচ্ছেন। আমাদের দেশে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায়ই অনিয়ম ও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর পাই পত্র-পত্রিকায়। বাস্তবেও এর প্রমাণ মিলেছে অনেক।

india

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী তাসনিম বিনতে আজিজ প্রাইমারিতে পড়া অবস্থায় হঠাৎ তার স্মৃতিশক্তি কমতে শুরু করে। তার বাবা মৌলভীবাজার, সিলেট থেকে শুরু করে ঢাকায় মেয়েকে বিভিন্ন ডাক্তার দেখাতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচে করে নিঃস্ব হয়েছেন, কিন্তু মেয়ে ভালো হয়নি। তাসনিমের বাবা ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলাম বুলু জানান, ঢাকায় একজন ডাক্তার জানান অপারেশন করলে কমে যাবে। তার কথা শুনে আমিও মেয়ের অপারেশন করাতে রাজি হয়ে যাই। কিন্তু অপারেশনের পর ঘটলো আরেক ঘটনা। সব সময় মেয়ের কানে ব্যথা লেগেই থাকতো। পরে মেয়ের কষ্ট দেখে আমি তাকে কলকাতা নিয়ে যাই। সেখানে ডাক্তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। সেগুলোর প্রতিবেদন দেখে ডাক্তার অঞ্জন মৃদু হাসেন এবং আমার মেয়ের সমস্যার জন্য কোনো ওষুধ না দিয়ে একটা ব্যায়াম শিখিয়ে দেন। কলকাতায় থেকে নিয়মিত সে ব্যায়াম করে তিন দিন পর দেখা করতে বলেন। তিন দিন পর মেয়ে ভালো হয়ে গেলো এবং ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলাম। এরপর তিনি দেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং একমাস এই ব্যায়াম করতে বললেন। চতুর্থ শ্রেণির আমার সেই মেয়ে এখন অনার্সে পড়ে। এখন পর্যন্ত তার আর কোনো সমস্যা হয়নি।

তিনি জানান, আমি এরপর থেকে অনেক রোগীকে ভারত পাঠিয়েছি। কিন্তু নিজের দেশ থাকতে ভারতে পাঠাতে আমার লজ্জা হয়। তারপরও পাঠাই কারণ জীবন তো বাঁচাতে হবে।

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ পৌর এলাকার বাবুল দেব পেশায় একজন ফার্মাসিস্ট। তার বড় ভাই মারা গেছেন হৃদরোগে। তিনিও প্রায় ৪ বছর আগে বুকে ব্যথা অনুভব করেন । সেই ব্যথা বাড়তে থাকায় ডাক্তারের কাছে যান। কিন্তু ভালো হবার কোনো লক্ষণ নেই। দুই বছর সিলেট, ঢাকার স্কয়ার ও অ্যাপোলো হাসপাতালের নামকরা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখান। সব ডাক্তারই জানেন তার হার্টের সমস্যা। নিয়মিত ওষুধ খেয়েও বুকের ব্যথা না কমে উল্টো তার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।

পরে কলকাতায় ডা. দেবী শেঠীর হাসপাতালে (নারায়না ইন্সটিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়িন্সেস) ডা. কুন্তুলের কাছে গেলে তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। প্রতিবেদন দেখে তিনি জানান, হার্টের কোনো সমস্যা নেই। তবে বুকে অন্য সমস্যা আছে। সেই সমস্যার জন্য তিনি ১৩০ রুপির ওষুধ দেন। ওই ওষুধ খেয়েই আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ অথচ এর আগে আমি লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। এসব কারণে আমার চিন্তায় পরিবার ঘুমায়নি রাতের পর রাত।

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বাঘবাড়ী এলাকার বিশ্বজিৎ দে জানান, প্রায় ১০ বছর আগে আমার কাকার শরীর খারাপ হয়। আমরা তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যক্ষ্মা হয়েছে জানিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। প্রায় ৩ মাস যক্ষ্মার ওষুধ খাওয়ানোর পর যখন উনার শরীরের আরও অবনতি হয় আমরা উনাকে নিয়ে ভারতের ভেলরে সিএমএইচ হাসপাতালে পাঠাই। সেখানে ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করে জানান, উনার গ্যাসের সমস্যা। যক্ষ্মা নেই। যক্ষ্মার ওষুধ খাওয়ার কারণে শরীরের যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য ওষুধ দেন। সেই ওষুধ খেয়ে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন।

২ বছর আগে তার বুকে ব্যথা শুরু হলে ডাক্তার এনজিওগ্রাম করানোর কথা বলেন। ঢাকা গিয়ে এনজিওগ্রাম করাই। এনজিওগ্রাম করা অবস্থায় ডাক্তার জানান, হার্টের সমস্যা। এখই হার্টে রিং লাগাতে হবে নয়ত বাঁচানো যাবে না। আমরা বাধ্য হয়ে টাকা জোগাড় করে ২টি রিং লাগাই। রিং লাগানোর একমাসের ভেতরে তিনি মারা যান। আমার বিশ্বাস সঠিক চিকিৎসা আমরা পাইনি। যদিও আগের ঘটনা থেকেই দেশের চিকিৎসার ওপর আস্থা হারিয়েছি ।

সিলেট পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন বিরেন্দ্র দে। একদিন অফিসে হঠাৎ বমি করতে করতে পড়ে যান। সহকর্মীরা মিলে নিয়ে যায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে। সেখানে বলা হয় গ্যাস্টিকের সমস্যা। বাসায় নিয়ে আসা হলে আবারও বমি হয়। পুনরায় নিয়ে যাওয়া হয় ওসমানী হাসপাতালে। সেখানে আবারও বলা হয় গ্যাসের সমস্যা। চার মাস পর আবারও বমি হলে এবার নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে। এরপর আরও কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এক বছর ধরে এসব হাসপাতালে উনাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলে কেউ গ্যাস্টিক, কেউ ডায়াবেটিকসের চিকিৎসা করেছে। কিন্তু এক বছর একজন ডাক্তারের চেম্বারে তাকে নিয়ে গেলে সেখানে ব্রেইনে অনেকগুলো টিউমার ধরা পরে। তিনি তখন পাঠান একজন নিউরোসার্জনের কাছে। নিউরো সার্জন জানান, টিউমার এতদিনে ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। অনেক দেরি হয়ে-গেছে। এখন চিকিৎসা করে আর লাভ হবে না। এর কিছু দিন পরই উনি মারা যান।

india

বিরেন্দ্র দে’র ভাতিজা শিপলু জাগো নিউজকে জানান, এসব হয়েছে আমার সামনেই। এরপর থেকে দেশের ডাক্তারদের প্রতি আমার আস্থা নেই। রোগ ধরতেই এক বছর চলে গেল। ঠিক যখন মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ।

মেডিকেল ভিসায় ভারতে রোগী পারাপারের বিষয়ে কথা হয় সিলেটের তামাবিল ইমিগ্রেশন পুলিশের এসআই রমজান মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, মেঘালয়ে ভালো কোনো হাসপাতাল না থাকায় এই সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে কম রোগী ভারত যায়। তবে অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে বেশি যাচ্ছে। তারপরও এ সীমান্ত দিয়ে গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন যাচ্ছে।

বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তরিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার মানুষ ভারত যাচ্ছে মেডিকেল ভিসা এবং ভ্রমণ ভিসা নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যে গড়ে এক হাজারের উপরে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। ২০ শতাংশ মানুষ মেডিকেল ভিসা নিয়ে গেলেও বেশির ভাগই ভ্রমণ ভিসায় গিয়েও চিকিৎসা করাচ্ছেন।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কেন্দ্রীয় মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে আমরা ভারত থেকে এগিয়ে আছি। উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে আমাদের চিকিৎসা সেবা ভারত থেকে অনেক ভালো। তবে উচ্চ পর্যায়ে ভারত এগিয়ে। তাদের প্রচুর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে অনেক ভালো যন্ত্রপাতি আছে।

ভারতে রোগীদের লাইন দীর্ঘ হবার ব্যাপারে তিনি তিনটি কারণ উল্লেখ করে বলেন,
১. আমাদের দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। তাই সামান্য কিছু হলেই ভারত যেতে চায়।
২. আমাদের দেশের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিপরীতে রোগী থাকে একশ জন। যার কারণে তারা রোগীদের সময় দিতে পারে না। কিন্তু ভারতে বিশেষজ্ঞ প্রচুর থাকায় রোগীকে প্রচুর সময় দেয়।
৩. হার্ট বা ক্যান্সারের রোগী হলে পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে যায় কোন ডাক্তার রেখে কোন ডাক্তার দেখাবে। তাই তারা কয়দিন দেশীয় ডাক্তার দেখানোর পরেই ভারত যাচ্ছে নিজেদের অস্থিরতা থেকে। তিনি আরও জানান, হার্টের চিকিৎসায় বাংলাদেশ অনেক ভালো করছে।

এমএএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।