৩ বছরে বদলে গেল বিলুপ্ত ছিটমহলের জীবনযাত্রা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুল আলোচিত স্থল সীমান্ত চুক্তির ৩ বছরে বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের জীবনযাত্রা। চুক্তি বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশি মূল ভূখণ্ডে যোগ হয় ১১১ ভারতীয় ছিটমহলের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি।
এরই ধারাবাহিকতায় পঞ্চগড়ের তিন উপজেলার বিলুপ্ত ৩৬ ছিটমহলের ৪৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ নাগরিকত্ব পান। ৬৮ বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে তারা গর্বিত বাংলাদেশি হয়ে যান।
এরপর অবহেলিত এসব জনপদে শুরু হয় সরকারের বিশেষ বরাদ্দের উন্নয়ন কাজ। সড়ক যোগাযোগসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তিন বছরে নানামুখি উন্নয়নে বদলে গেছে এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা।
এক সময় নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এসব এলাকার শিশুদের মিথ্যা নাম পরিচয়ে লেখাপড়া করতে হতো। এখন নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যাতায়াতের পাকা সড়ক আর বিদ্যুতের আলোয় শিশুদের জীবনকে আলোকিত করে তুলেছে।
জানা গেছে, জেলার বিলুপ্ত ৩৬ ছিটমহলের ৪৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হওয়ার পর তিন বছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে এখানে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) মাধ্যমে সড়ক উন্নয়ন, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে প্রায় ৯০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বোদা উপজেলার নাজিরগঞ্জ দইখাতা ছিটমহলের করতোয়া তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ৬ হাজার পরিবারের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং সার্বিক নিরাপত্তার জন্য দুটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া ৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মহাবিদ্যালয়, একটি আলিম মাদরাসা, বেশ কয়েকটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল করা হয়েছে। পাশাপাশি সমাজ সেবা অধিদফতরের আওতায় ১ হাজার ২৮৪ জনকে বয়স্কভাতা, ৫৩৮ জনকে বিধবাভাতা, ৩৩৮ অসচ্ছল প্রতিবন্ধীর জন্য বিশেষ ভাতাসহ বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকায় ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ভাতা দেয়া হয়েছে।
২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে (১ আগস্ট) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশি নাগরিক এবং ভারতে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতের নাগরিক হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
মঙ্গলবার ঐতিহাসিক দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনে বিলুপ্ত ছিটমহলে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা ও শিশুদের খেলাধুলাসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
সদর উপজেলার বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহলের রাজমহল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রহিমা খাতুন জানায়, একসময় আমাদের এলাকার রাস্তা দিয়ে ঠিকমতো হেঁটে চলা যেত না। আমাদের কোনো স্কুল ছিল না। মিথ্যা নাম-পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশি স্কুলে লেখাপড়া করতে হতো। এখন আমরা পাকা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাই। স্কুল যাতায়াতের জন্য সাইকেলটিও দিয়েছে স্কুল থেকে। আমরা এখন নিজের স্কুলেই লেখাপড়া করছি।
বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহল এলাকার ষাটোর্ধ্ব আব্দুল জব্বার বলেন, আমাদের মানুষের মর্যাদা ছিল না। এলাকায় কোনো আইন-কানুন ছিল না। একজন নাগরিক যেসব সুবিধা পায় আমরা তা পেতাম না। আমাদের শিশুরা ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে ছিটমহলের পাশের স্কুলে লেখাপড়া করতো। সন্ধ্যার পর একটু আলোর জন্য কুপিবাতি আর মমবাতিই ছিল ভরসা। এখন এলাকার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুতের আলো আমাদের জীবনযাপন বদলে গেছে। শেখ হাসিনা সরকার আমাদের জীবনের অন্ধকার দূর করেছেন।
গারাতি ছিটমহলের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজার রহমান বলেন, তিন বছরে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন হয়েছে ছিটমহল এলাকায়। ছিটমহলের পাশে বাংলাদেশি এলাকার অনেক বাড়িতে এখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি। কিন্তু বিলুপ্ত ছিটমহলের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলছে। উন্নত যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত সহায়তার ব্যবস্থায় আমরা এখন গর্বিত বাংলাদেশি নাগরিকের মর্যাদায় জীবন-যাপন করছি। দিনটি পালনে আমরা দু’দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছি।
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ গোলাম আজম বলেন, আজকের বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকা একসময় প্রকৃত অর্থেই অবহেলিত ছিল। সেখানকার মানুষের কোনো মর্যাদা ছিল না। এখন তারা নাগরিকত্বের মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। সেখানে গত তিন বছরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সেই প্রত্যন্ত এলাকার অধিবাসীরা থ্রি-জি সেবা পাচ্ছেন। সেখানে একটি আইসিটি পার্কের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) মাধ্যমে সড়ক উন্নয়ন, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে প্রায় ৯০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বোদা উপজেলার বিলুপ্ত নাজিরগঞ্জ দইখাতা ছিটমহলের করতোয়া তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন বিভাগ উন্নয়নমূলক নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সেখানে।
সফিকুল আলম/এএম/এমএস