‘জালে ওহন আর মাছ পাই না’
‘জালে ওহন আর মাছ পাই না। আগে নদীতে গেলেই মাছ পাইতাম। বেলা উঠার আগেই পাড়ার জেলেদের নিয়ে নদীতে যাইতাম। কত সময় পালানে (পরিত্যাক্ত জমি) জাল বাইতাম। ঘণ্টা খানেক জাল বেয়ে দশটার আগেই বাজারে মাছ উঠাইতাম। কাওরে ভাগ ভাটওয়ারাও দিতে অইতো না। যা কামাইতাম ওতেই সংসার চইলা যাইতো। ওহন মাছ সব পালা। খোলা পানিতে চাইলেই মাছ পাই না। ওহন পালা মাছ মাইরা দিতে অয়। একদিন একজনের পুকুরে পালা মাছ মাইরা দিলে পরের দিন বেকার বইয়া থাকি।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের জেলে পাড়ার ফনিন্দ্র রাজবংশী। ফনিন্দ্রের মতো জেলে সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মা মাছ নিধন, কারেন্ট জালের ব্যবহার, কৃষি জমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ কারণে আগের তুলনায় জলাশয়ে মাছ অনেক কমে গেছে বলে মনে করছেন এ অঞ্চলের জেলেরা।
কদিন আগেও বলা হত মাছে-ভাতে বাঙালি। গোলার ধান আর পুকুরের মাছ যেন সহজলভ্য ছিল প্রতিটি বাঙালির কাছে। নব্বই দশকেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। একবিংশ শতাব্দি বাঙালির দরজায় যখন থেকে নাড়া দিল তখন থেকেই মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা যেন হারিয়ে যেতে লাগল। কৃষি জমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে জলাশয়ের স্বচ্ছ পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। আর বিষাক্ত পানির কারণে দেশীয় মাছ কমে গেছে।
এছাড়াও বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে মা মাছগুলো নিধণের ফলেও মাছ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ফলে দেশীয় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ অস্তিত্ব হুমকিতে পড়েছে। টাঙ্গাইলে নদ-নদীতে মাছ কমে যাওয়ার ফলে দিনদিন পেশা ছাড়ছে এ অঞ্চলের জেলেরা। দরিদ্র জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে অর্থাভাবে অন্য কোনো পেশায়ও যেতে পারছেন না। ফলে অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
জেলে লক্ষ্মণ রাজবংশী বলেন, এক সময় মাছ ধরতে গেলে মাছে নৌকা বোঝায় হয়ে যেতো। কিন্তু এখন আগের তুলনায় ৫ ভাগের এক ভাগও মাছ ধরা যায় না। খাল-বিলে মাছ কমে যাওয়ায় অনেক জেলে বাব-দাদার পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। আগে খোলা নদীনালা থেকে স্বাধীনভাবে মাছে ধরে সংসার ভালোভাবেই চলে যেত। এখন মুক্ত নদ-নদীতে আগের মতো মাছ না থাকায় চাষ করা পুকুরে দিনমুজুর হিসেবে মাছ ধরে দিতে হয়। এতে সপ্তাহে দু-একদিন এ ধরণের পুকুরে মাছ ধরার সুযোগ পেলেও বেশিরভাগ দিন কাটে অবসরে।
বছরে একবার মৎস সপ্তাহের সময় নানা পদক্ষেপে স্বপ্ন দেখালেও সারাবছর বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না এমন অভিযোগ জেলেদের।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৪১ হাজার ৪৯৫টি পুকুর রয়েছে। এছাড়াও বিল ২৯৮টি, বাঁওড় ৩টি, পেন কালচার ৪টি, ৮টি নদী ও ১২৮টি খাল রয়েছে। এ এলাকায় মাছের চাহিদা ৭৩ হাজার মেট্রিক টন। মুক্ত জলাশয়ে মাছ কমে যাওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ বাড়িয়ে মাছের চাহিদা পুরণ হচ্ছে না। বর্তমানে হাইব্রিড বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে এসব মাছ চাষের আগে পুকুর ও ডোবার পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোয় মাছ, শামুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণির প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশীয় মাছের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, কৃষি জমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ কারণে আগের তুলনায় প্রাকৃতিক মাছ অনেক কমে গেছে। এক সময় জেলেরা মাছ ধরে ভালোভাবে সংসার চালাতে পারতো। কিন্তু এখন তাদের সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, দেশি মাছ সংরক্ষণে হ্যাচারি স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যেই এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনেককেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যেখানে পানি কম থাকে সেখানে মৌসুমী মাছ চাষ করা হবে।
আরিফ উর রহমান টগর/আরএআর/জেআইএম