গাইবান্ধায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার উদাহরণ আবু জাফর সাবু

রওশন আলম পাপুল
রওশন আলম পাপুল রওশন আলম পাপুল গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ০৬:০২ পিএম, ১৬ জুলাই ২০১৮

আবু জাফর সাবু। সত্তর বছর পেরিয়ে সবে পা দিয়েছেন একাত্তরে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি দেশজুড়ে যার পরিচিতি রয়েছে ছড়াকার হিসেবে। এ ছাড়াও লেখেন ছোটগল্প, গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, কথিকা, জীবন ঘনিষ্ঠ ফিচার ও ভ্রমণকাহিনি। সুনাম নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। প্রকাশিত হয়েছে ছড়া ও কাব্যগ্রন্থসহ কয়েকটি বই।

সম্প্রতি গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে আবু জাফর সাবুর পারিবারিক ও ৪২ বছরের দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের নানান ঘটনার কথা।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আবু জাফর সাবুর জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৭ জুন গাইবান্ধা জেলা শহরের অনামিকা লেনস্থ তার নানার বাড়িতে। বাড়ি শহরের ডেভিডকোম্পানি পাড়ায়। বাবা নাট্যব্যক্তিত্ব আব্দুর রশীদ আর মা লুৎফুন নেছা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী।

তিনি গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি, গাইবান্ধা কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী সুফিয়া খাতুন গৃহিণী। বড় ছেলে আবু সুফিয়ান রনি চাকরি করছেন ও ছোট ছেলে আবু কায়সার শিপলু জড়িত রয়েছেন সাংবাদিকতা পেশায়। একমাত্র মেয়ে জাফরিন আকতার সুমি স্বামী সৈয়দ আবু হেনা মুকুল ও ছেলে স্বপ্নীলকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।

আবু জাফর সাবু ছোট গল্প ও ছড়া লেখা শুরু করেন ১৯৬৩ সাল থেকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকাসহ কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় তার অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এরপর ১৯৮০ সালে তিনি বেতারে কথিকা ও কবিতা পাঠ শুরু করেন।

১৯৯৪ সালের ১৭ নভেম্বর গীতিকার এবং ১৯৮৯ সালের ২৫ আগস্ট থেকে তালিকাভুক্ত নাট্যকার হিসেবে রংপুর বেতারে গান এবং নাটক লিখতে শুরু করেন। বর্তমানে তিনি রংপুর বেতারের ‘ক’ মানের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও নাট্যকার হিসেবেও নিয়মিত নাটক এবং গান লিখছেন।

Abd-Jafor-Sabu-(2)

আবু জাফর সাবু ১৯৭৬ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন রংপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মহাকাল পত্রিকার মাধ্যমে। এরপর ঢাকার সাপ্তাহিক জাহান ও দৈনিক দেশ পত্রিকায় মহুকুমা ও জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া গাইবান্ধা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঘাঘটের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পলাশের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সমবায় বিভাগে সহকারী পরিদর্শক হিসেবে সরকারি চাকরিতে কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর গাইবান্ধার একটি স্বয়ংক্রীয় ধানকলে এক যুগ অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবেও চাকরি করেছেন। পরে ১৯৮৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০২ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি এবং অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন ১৯৯৬ সালে। বর্তমানে আবু জাফর সাবু ২০০২ সালের ১ নভেম্বর থেকে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠের জেলা প্রতিনিধি, স্থানীয় দৈনিক আজকের জনগণ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

আবু জাফর সাবু বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, ইউনেস্কো ক্লাব গাইবান্ধা শাখার সাধারণ সম্পাদক, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র গাইবান্ধা শাখার জেলা সংগঠক, গাইবান্ধা সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় সাহিত্য পরিষদ গাইবান্ধা জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বর্তমানে সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরবানী সংসদের সভাপতি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাইবান্ধা ডায়াবেটিক সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, কর্মীর হাতের সাধারণ সম্পাদক, গাইবান্ধা জেলা মানবাধিকার ফোরামের আহ্বায়ক, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি গাইবান্ধা জেলা শাখার নির্বাহী কমিটির সদস্য, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্য পদে রয়েছেন। এ ছাড়াও আরও অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত তিনি।

আবু জাফর সাবু ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের মহকুমাভিত্তিক সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। বিভিন্ন সময়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত শিশু কাব্য নাটিকার বই ‘বুনো হাঁস ও নেংটি ইঁদুর’, আলপনা প্রকাশনীর ছড়ার বই ‘ছন্দের আল্পনা’ আলোকিত গাইবান্ধার প্রকাশনায় ছড়ার বই ‘ঘুম ভাঙানিয়া ছড়া’, ও ‘স্বপ্নীলের জন্য ছড়া’, ভারত ভ্রমণকাহিনি ‘শান্তিনিকেতন থেকে তাজমহল’ ও শিশু-কিশোর ছোট গল্প গ্রন্থ ‘মামা কাহিনি ও অন্যান্য গল্প’ এবং কবিতার বই ‘পড়ন্ত বিকেলের রোদ’।

সাংবাদিকতা করেই আবু জাফর সাবু তার সন্তানদের অত্যন্ত কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় করেছেন। স্ত্রীর নামে বসতভিটা ছাড়া অন্য কোনো সম্পত্তি নেই তার। সাংবাদিকতা পেশার ওপর নির্ভর করেই চলছে তার সংসার। সাংবাদিকতা সম্মান ও শ্রদ্ধার পেশা হওয়ায় সবসময় পেয়েছেন স্ত্রী ও সন্তানদের পূর্ণ সমর্থন এবং আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন বলেন, অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করলেও কখনও তাকে বলিনি তুমি সাংবাদিকতা ছেড়ে দাও। সাংবাদিকতা সম্মান ও শ্রদ্ধার পেশা হওয়ায় সবসময় তাকে উৎসাহ দিয়েছি।

তিনি বলেন, তার স্বামী এই পেশায় সবসময় অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। আমি কখনই তাকে অসৎ উদ্দেশ্যে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করতে দেখিনি। তিনি এ ক্ষেত্রে সামান্য অসৎ উপায় অবলম্বন করলে আমাদের এতো কষ্ট করতে হতো না। বরং সংসার জীবনে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য আসতো।

আবু জাফর সাবুর মেয়ে জাফরিন আক্তার সুমি বলেন, আমার বাবা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশেষ্ঠ এবং সবচেয়ে ভালো একজন বাবা। আমি তার সবসময় মঙ্গল ও সুস্থতা কামনা করি। তিনি আমার জীবন চলার পথের পথেয় ও অনুপ্রেরণা। আমি সারাটা জীবন তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে চাই।

স্মৃতিচারণ করে আবু জাফর সাবু বলেন, আশির দশকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জস্থ রংপুর চিনিকলের জেনারেল ম্যানেজারের (জিএম) দুর্নীতি-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দৈনিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশকে কেন্দ্র করে আবু জাফর সাবুসহ দুইজন সাংবাদিককে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের সেনা আদালতে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে সেখানে সেনা আদালতে শুনানির পর তাদের সংবাদে পরিবেশিত তথ্য সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় ওইদিনই তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়।

Abd-Jafor-Sabu

তিনি আরও বলেন, তৎকালীন মহকুমা শহরে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকানগুলোতে রেকটিফাইড স্পিরিট মাদকদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার হতো। অথচ সেই ব্যাপারে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছিল না। এসময় আবু জাফর সাবুর প্রকাশিত একটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রংপুর জেলা প্রশাসন থেকে গাইবান্ধা মহকুমা শহরে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং হোমিওপ্যাথিক দোকানগুলোতে এই রেকটিফাইড স্পিরিট সরবরাহের কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যা আজও বহাল আছে। তার এই প্রকাশিত সংবাদের কারণ গাইবান্ধাবাসী মাদকের ভয়াবহতা থেকে সুফল লাভ করে এবং এই সংবাদটি উচ্ছসিত প্রশংসিত হয়।

সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে আবু জাফর সাবু বলেন, আমার মা আমাকে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। সাংবাদিকতাকে আমি পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও এটা আসলে আমার অন্তর্নিহিত একটি নেশা। এই নেশার মাধ্যমেই আমি অত্যন্ত আন্তরিকার সঙ্গে জনকল্যাণে নিবেদিত থাকতে চাই এবং সবসময় মনে করি, দুঃস্থ জনগণের কল্যাণে এবং দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে আন্তরিকভাবে নিবেদিত হোক সাংবাদিকতা।

প্রবীণ পাঠক ও প্রাক্তন অধ্যাপক কবি ইবনে সিরাজ বলেন, সাংবাদিকতায় আবু জাফর সাবু অত্যন্ত নিবেদিত। বিশেষ করে সংবাদ ও জীবন ঘনিষ্ঠ ফিচারগুলো পরিবেশনায় তিনি অত্যন্ত যত্নশীল এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নির্ভর সংবাদ পরিবেশনায় তিনি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে থাকেন। তার লিখিত ফিচার এবং সংবাদগুলো পড়ে আমার এই ধারণা জন্মেছে।

স্থানীয় সাপ্তাহিক গাইবান্ধার কথা পত্রিকার সম্পাদক রেজাউল হক মিতা বলেন, আমি দেখেছি আবু জাফর সাবু সংবাদের খোঁজে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তুলে এনেছেন খবরের ভেতরের খবর। তার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর উপকার হয়েছে এমন মানুষ ও বিষয়ের সংখ্যাও অনেক।

গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবের সভাপতি কে এম রেজাউল হক বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আবু জাফর সাবু নিজেই একটি উদাহরণ। সাংবাদিকতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এই সেবামূলক কাজে তার একনিষ্ঠতা এবং দক্ষতা তার পেশাগত জীবনকে অবশ্যই আলোকিত করেছে।

এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।