আনন্দ স্কুলে সবই আছে আবার কিছুই নেই
ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার চরাঞ্চলের ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করাই মূল্য লক্ষ্য আনন্দ স্কুলের। এ প্রকল্পের আওতায় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে প্রতিটি স্কুলে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর বিধান রয়েছে। আনন্দ স্কুলের প্রতিজন শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে বই, ড্রেস, খাতা কলম ও শিক্ষা উপকরণসহ মাসিক শিক্ষা ভাতা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এসব বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে শিক্ষার্থীর খাতা কলম ও শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের অর্থ প্রতিমাসে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের ব্যাংক একাউন্টে পাঠানো হয়। আর শিক্ষার্থীর ড্রেস ও মাসিক ভাতা প্রদানের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ উপজেলা সমন্বয়কারীর মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।
কিন্তু এ উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ৮২টি আনন্দ স্কুলে প্রায় ১ হাজার ২৮৫ জন ছাত্রছাত্রী দেখানো হলেও রয়েছে সর্বোচ্চ ৫শ’ শিক্ষার্থী। এলাকাবাসীর অভিযোগ আনন্দ স্কুল সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমন্বয়কারী, শিক্ষক ও বিদ্যালয় সভাপতি মিলে ভূয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দ লোপাট করে চলেছেন। এমনকি অভিযোগ রয়েছে গ্রামের বিভিন্ন বসতবাড়ির একটি ঘর ভাড়া করে কোনো রকমে লোকদেখানো পাঠদান চলছে এসব স্কুলে।
চরভদ্রাসনের ৮২টি স্কুলের মধ্যে চরভদ্রাসন সদর ইউনিয়নে ৩৫টি স্কুল, গাজীরটেক ইউনিয়নে ৩৪টি, চরহরিরামপুর ইউনিয়নে ১১টি ও চরঝাউকান্দা ইউনিয়নে রয়েছে মাত্র ৩টি স্কুল। গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন বসতবাড়ির একটি ঘর ভাড়া নিয়ে গড়া হয়েছে এসব আনন্দ স্কুল।
উপজেলা সদরের পূর্ব বিএস ডাঙ্গী গ্রামের শেখ করিমের বসতবাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে গড়া আনন্দ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলে কোনো ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক নেই। স্কুলের দরজা জানালা খোলা। ঘরের মধ্যে কয়েক জোড়া বেঞ্চ ও একটি ব্ল্যাক বোর্ড আগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে।
ওই বাড়ির গৃহিণী আকলিমা বেগম জানান, বাড়ির ওই ঘরটি আনন্দ স্কুলের জন্য মাসিক ৫শ টাকা হারে ভাড়া দেয়া হয়েছে। স্কুলের শিক্ষিকা সেলিনা আক্তার মাঝে মধ্যে এসে ৪-৫ জনকে পড়ান।
স্কুলের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা শেখ তোতা মিয়া বলেন, এ স্কুলে খাতা কলমে ২৫ জন ছাত্রছাত্রী দেখানো হয়েছে। আগে কয়েকজন ছেলেমেয়ে স্কুলে আসত কিন্তু অনেকদিন ধরে কোনো ছেলে মেয়ে বা শিক্ষককে স্কুলে আসতে দেখি না।
আনন্দ স্কুলের শিক্ষিকা সেলিনা পারভিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার স্বামী মো. খবিরদ্দিন জানান, স্কুলে এখন আর আমার স্ত্রী যায় না, স্ত্রীর পরিবর্তে আমার শ্যালিকা হাবিবা আক্তার শিক্ষকতা করেন।
এছাড়া উপজেলার বাদুল্ল্যা মাতুব্বরের ডাঙ্গী গ্রামে, হাজীডাঙ্গী গ্রামে ও এমপি ডাঙ্গী গ্রামের আনন্দ স্কুলগুলোতে গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, প্রতিমাসে উপজেলা কো-অর্ডিনেটরকে ২-৩ হাজার করে টাকা দিতে হয়, না দিলে স্কুল বন্ধ করে দেবেন বলে হুমকী দেয়। ভূয়া ছাত্রছাত্রী না দেখিয়ে চাকরি করা সম্ভব না।
এ ব্যাপারে আনন্দ স্কুলের উপজেলা সমন্বয়কারী শাহীনুজ্জামান বলেন, আনন্দ স্কুল বাবদ বছরে উপজেলায় প্রায় অর্ধকোটি টাকা বরাদ্দ আসে। এরমধ্যে ছাত্র প্রতি ১২০ টাকা করে মাসিক শিক্ষা ভাতা ছয় মাস পর পর একবারে শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবকের হাতে তুলে দেয়া হয়। কাজেই অর্থ আত্মসাতের কোনো সুযোগ নেই। আর খাতা কলম ও শিক্ষা উপকরণের টাকা স্কুলের শিক্ষক ও সভাপতির যৌথ একাউন্টে চলে আসে, বিধায় সে ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।
চরভদ্রাসন উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আশরাফুল হক বলেন, আনন্দ স্কুল নিয়ে অনেক অভিযোগ আমার কানে আসছে। এ মাসেই আমি সবকটি স্কুল পরিদর্শন করবো। অনিয়ম পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন নাহার জানান, আনন্দ স্কুলের অনিয়মের বিষয়টি জানতে পেরেছি। সমন্বয়কারীকে ডেকে এনে সবগুলো স্কুলের তথ্য চেয়েছি। এছাড়া স্কুলের সকল শিক্ষককে উপজেলা কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে।
এফএ/আরআইপি