কালের সাক্ষী জরাজীর্ণ ভুজপুর কাজী বাড়ি
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জরাজীর্ণ ফটিকছড়ির ভুজপুর কাজী বাড়ি। বাড়ির দেয়ালগুলোতে এখন উঠেছে ছোট ছোট বটবৃক্ষের চারা। নানা ধরনের লতাপাতায় ছেয়ে গেছে বাড়ির দেয়ালগুলো। ধসে পড়েছে উপরের ছাদ। ভুজপুরের কাজির হাট বাজারে দক্ষিণ পশ্চিম পার্শ্বে একটি টিলার উপর অবস্থিত বাড়িটি বর্তমানে কাজী বাড়ি বা মিঞা বাড়ি নামে পরিচিত।
ষাট কক্ষের বিশাল প্রাসাদ এখন অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে। সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন বিলুপ্তির পথে ভুজপুরের এ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি। বাড়ির চারপাশের পরিখাঁ এখন আর নেই। এখন আর প্রতি রাতে বসেনা নাচ গানের আসর। নেই জমিদারের সোনা রূপাখচিত আলিশান চেয়ার। প্রতি বছর এখন হয়না রাজপুণ্যাহ উৎসব।
দেয়াল দরজা জানালার প্রতিটি অংশে মোগল স্থাপত্যের ছোঁয়াও এখন মুছে গেছে। বাড়ির উপরের তলার ফাঁসির মঞ্চটিও এখন আর নেই। চার পাশের দেয়ালগুলোই শুধু ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তবে কাজী বাড়ি যাওয়ার একশ গজ আগে উত্তর পার্শ্বে চোখে পড়বে নয়নাভিরাম মোগল স্থাপত্যের স্মৃতি কাজী বাড়ি মসজিদ।
তিনটি গম্বুজ আর ১২টি ছোট মিনারযুক্ত মসজিদটি। আড়াইশত বছর আগে তুর্কী প্রকৌশলীরা চুন সুরকির দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন এ মসজিদটি। কালের আবর্তে মুসল্লি বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৯৭-৯৮ সালে এর বারান্দা নির্মাণ করা হয় বলে জানা গেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত উত্তর চট্টগ্রামের বিখ্যাত জমিদার কাজি শাহাব উদ্দিন চৌধুরীর জমিদার বাড়ির গল্প এটি। জমিদার শাহাব উদ্দিন বা হাসমত আলী কেউ এখন আর বেঁচে নেই। নেই জমিদার বাড়ির আগের সেই জৌলুশ। বিখ্যাত এবং বহুল আলোচিত এই জমিদার বাড়ির অবস্থান ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায়।
জানা যায়, কাজি শাহাব উদ্দিন চৌধুরীর আদি পুরুষ ছিলেন মহব্বত সাধু। তিনি গৌড় নগরে বসবাস করতেন। সমুদ্র পথে চট্টগ্রাম এসে তিনি স্বস্ত্রীক বসতি স্থাপন করেন ফেনীর দাঁদরায়। তার একমাত্র ছেলের নাম সাদল্লাহ। সাদল্লাহর তিন ছেলের একজন কাজি শাহাব উদ্দিন চৌধুরী। অন্য দুজন হলেন আনিস মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ হোসন। কাজি শাহাব উদ্দিনের তিন ছেলের একজন কাজি হাসমত আলি চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। আলিফ লায়লা ও চিনফুকস শাহ নামের তার দুটি পুঁথি রয়েছে।
বংশ পরম্পরায় কাজি শাহাব উদ্দিন চৌধুরীর ও তার বংশধররা প্রায় দুশ বছর জমিদারি করেছেন ভুজপুরে। ভুজুপর বাজারটি তখন থেকে কাজিরহাট নামে পরিচিত। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ছিল তাদের জমিদারি। ফটিকছড়ির প্রায় অর্ধশত বর্গকিলোমিটার এলাকা জমিদারির আওতায় ছিল। প্রতি বছর রাজপুণ্যায় হাজার হাজার লোক খাজনা দিতে আসতেন কাজি বাড়িতে।
বর্তমানে বেঁচে থাকা জমিদার পরিবারের সন্তান শিক্ষক কাজি ইকবাল হোসেন জাগো নিউজকে জানান, তখন জমিদার হায়দার আলীর আমলে জমিদারির আওতায় মোগল স্থাপত্যের আদলে ২৪টি মহাল ১২টি তরফ ছিল। এছাড়া ২২টি পুকুর (দীঘি) ২২টি মসজিদসহ ছিল বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠান। অনেক রাস্তাসহ ২২টি (হাতির পুল) ব্রিজ কালভার্টও নির্মাণ করেছিলেন । ১৭৬৫ থেকে ১৮৪৫ সালে এগুলো নির্মাণ করা হয়। জানা গেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর তাদের বংশধর।
কাজি বাড়িতে একটি ফাঁসির মঞ্চ নিয়ে জমিদার বাড়ির লোকজনের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন কথা। শিক্ষক ইকবাল হোসেন জাগো নিউজকে জানান, এটি ছিল একটি প্রতিকী মঞ্চ। বৃটিশ লর্ড সকল প্রশাসনিক কাজ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে কাজি শাহাব উদ্দিনকে জমিদারী চালাতে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। এতে বিচারিক কর্মকাণ্ড চালানো এবং বছরে অন্তত সাতজনকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। যা পরবর্তীতে ফাঁসির মঞ্চ হিসেবে প্রকাশ পায়।
জমিদার বংশের অপর সন্তান ব্যবসায়ী কাজী তৌহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী বহু স্মৃতিবিজড়িত কাজি বাড়ী সংরক্ষণের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে তারা লিখিত অনেক আবেদন নিবেদন করেছেন। কিন্তু এটির সংস্কার বা সংরক্ষণে সরকারি কোনো প্রকার সহায়তা পাওয়া যায়নি।
এমজেড/পিআর