ঈদের ছুটিতে তুচ্ছ ঘটনায় চট্টগ্রামে ঝরলো তিন প্রাণ
পুরো দেশ যখন ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা, তখন চট্টগ্রামের তিন পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তুচ্ছ তিনটি পৃথক ঘটনায় ঈদ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় খুন হয়েছেন তিন যুবক। আশঙ্কার কথা হলো এই তিনটি হত্যাকাণ্ডই ঘটেছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে, যার দুটি ঘটেছে নিহতদের বন্ধুদের দ্বারা।
প্রতিটি ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও এসব ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তুচ্ছ বিষয়ে ঝগড়ার জেরে এভাবে খুনের ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন সমাজের বিশিষ্টজনরা।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এর প্রধান কারণ। নৈতিক অবক্ষয়, প্রতিহিংসা চরিতার্থ ও মাদকের ভয়ঙ্কর ছোবলসহ অনেক কারণ রয়েছে এর পেছনে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন নিষ্ঠুরতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সামাজিকভাবে খুনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে মোট ১৭ হাজার ৫২১ জন খুন হয়েছেন (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)। এরমধ্যে ২০১৭ সালে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৯ জন, ২০১৬ সালে ৮৭৯ জন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫ জন, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ জন এবং ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে খুন হয়েছেন ৫৪৭ জন। এই দুই মাসে রাজধানীতে খুন হয়েছে ২৯ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডই বীভত্স ও রোমহর্ষক।
বাবার সামনে ছেলেকে হত্যা
ঈদের পরদিন রোববার (১৭ জুন) চট্টগ্রাম নগরের চট্টেশ্বরী মোড়ে তুচ্ছ ঘটনার জেরে পূর্বপরিচিত যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হন দামপাড়া পল্টন রোডের নাসির উদ্দিনের ছেলে মো. অনিক (২৭)। হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে বাবা নাসিরউদ্দিনের চোখের সামনেই।
সূত্র জানায়, অনিক ছোট ভাই রনিকসহ ওই দিন বিকেলে মোটরসাইকেল নিয়ে ব্যাটারি গলির দিকে যাচ্ছিলেন। গলিতে ঢোকার সময় লোকজনকে দেখে উচ্চস্বরে হর্ণ দেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত স্থানীয় কয়েক যুবকের সঙ্গে অনিকের বাকবিতণ্ডা ও মারামারি হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গেলে উভয়পক্ষ ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। বিকেলের মারামারির জের ধরে ব্যাটারিগলির মহিউদ্দিন তুষার ও ঈমনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন উঠতি বয়সী তরুণ সংঘবদ্ধ হয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে চট্টেশ্বরী মোড়ে যান। সেখানে অনিক ও তাদের বাবা নাসিরউদ্দিনও ছিলেন। দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ব্যাটারি গলি থেকে যাওয়া যুবকরা অনিককে কয়েক দফা ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। এসময় ফাঁকা গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটে।
তখন চোখের সামনেই ছেলেকে ছুরিকাহত হতে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন নাসির উদ্দিন। এক পর্যায়ে শরীরে ছুরিকাঘাতের একাধিক রক্তাক্ত জখম নিয়ে কাতরাতে থাকা ছেলেকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক অনিককে মৃত ঘোষণা করেন।
ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে কিশোরের মৃত্যু
একই দিন (১৭ জুন) রাতে নগরের হালিশহরের আর্টিলারি রোড সংলগ্ন বিডিআর হলে সিনেমা দেখে বাসায় ফিরছিল কিশোর মো. সুমন (১৭) ও তার বন্ধুরা। আর্টিলারি রোড ধরে কিছুদূর আসার পর একদল যুবক তাদের পথ আটকে মোবাইল ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সুমন ও তার বন্ধুদের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে সুমন ও তার এক বন্ধুকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় দৃর্বৃত্তরা। এরপর দু’জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনার পর সুমন মারা যায়। আহত অপর বন্ধু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এ ঘটনায় সুমনের ভাই বাদী হয়ে হালিশহর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন।
মাত্র এক হাজার টাকার জন্য
পরের দিন সোমবার (১৮ জুন) রাতে বাকলিয়া থানার ময়দার মিল এলাকায় আব্দুল গণি বাই লেন এলাকায় বন্ধুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে জসিম উদ্দিন (১৮) নামে স্থানীয় এক তরুণ। পুলিশ বলছে, জসিমের বন্ধু মোবারক হোসেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী জানান, জসিম ও মোবারক দুই বন্ধু। মোবারক হকার্স মার্কেটে শার্টের দোকানে কাজ করে। ঈদের আগে সে জসিমকে একটি শার্ট দিয়েছিল বিক্রির জন্য। সোমবার মোবারক শার্ট বিক্রির এক হাজার টাকা চাইতে গেলে জসিম তার কাছে আগের এক হাজার টাকা পাওনা থাকার কথা জানায়। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মোবারক জসিমের পেটে ছুরিকাঘাত করে। আহত অবস্থায় জসিমকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পর মোবারক পালিয়ে যায়। তাকে ধরতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
এর আগে গত ২১ মে জিমনেসিয়ামের গেট খোলা নিয়ে বিরোধের জেরে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার মোহরা রাস্তার মাথা এলাকায় সমবয়সী বন্ধুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয় আরাফাত (১৭) নামে এক কিশোর। তারও আগে ২ মে নগরীর পতেঙ্গা সৈকত থেকে সানসাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, স্কুলছাত্রীর ‘প্রেমিক’ নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় নিহতের বাবা মোহাম্মদ আমিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় কথিত প্রেমিক আদনান মির্জাসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়।
সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ওবায়দুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আগের চেয়ে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সমাজ নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে পরিবার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা চিন্তা ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে মানুষের মধ্যে সব সময় একজন আরেকজনকে যেভাবে ছাড় দেয়ার মানসিকতা বা একসঙ্গে চলার মানসিকতা ছিল- সেটার পরিবর্তে এখন ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা এক ধরনের সহিংসমূলক আচরণের দিকে ধাবিত করছে।’
আবু আজাদ/এমএমজেড/পিআর