রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আনন্দ-বেদনার ঈদ
রাষ্ট্রীয় সুবিধা না পেলেও গত বছরের ঈদুল ফিতরও নিজ দেশে কেটেছে আরাকানে (রাখাইন) বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের। কিন্তু ঈদুল আজহার পূর্বরাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে দেশ ছেড়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। হত্যা শিকার হয়েছেন হাজার হাজার নারী-শিশু-যুবক। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আবাসন, খাবার ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছেন।
এখানে সার্বিক দিক দিয়ে ভালো থাকলেও আজকের ঈদুল ফিতরে ফেলে আসা পুরনো বছরের স্মৃতি সবাইকে বিচলিত করে তুলেছে। পরিবার ও স্বজনহীন রোহিঙ্গারা স্মৃতি রোমন্থন করে বিলাপ করছেন।
ঈদের নামাজ শেষে নিজ দেশে নিরাপদে ফিরতে এবং বাংলাদেশের মঙ্গলের জন্য দোয়াও করেছেন তারা। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মক্তব) ও টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫টি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪৫টি মসজিদ ও ২০টি মক্তবে রোহিঙ্গারা ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। সকাল থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় নামাজ আদায়ে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি।
কুতুপালং মধুরছরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সালামত উল্লাহ বলেন, আরাকানে আমরা স্বজনদের হারিয়েছি। আজ প্রায় ১০ মাস আশ্রিত জীবন কাটাচ্ছি বাংলাদেশে। আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কোনো আশার আলো দেখছি না। এরপরও বাংলাদেশ আমাদের জন্য অনেক কিছু করছে। তাই মোনাজাতে নিজ দেশে নিরাপদে ফিরতে এবং বাংলাদেশের মঙ্গলের জন্য দোয়া করেছি আমরা।
অপরদিকে হৃদয়ের চলমান রক্ষক্ষরণ আর নিপীড়নের ক্ষত মুছে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরের মাঝে ঈদের খুশি ছড়াতে করা হয় অন্যরকম আয়োজন। কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের খেলার মাঠে শিশুদের আনন্দ দিতে বসানো হয়েছে কয়েকটি নাগরদোলা আর বেশ কয়েকটা মৌসুমী পণ্যের দোকান।
কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা আলী, সব্বির আহমদ ও আবুল কালাম বলেন, আরাকানে (রাখাইনে) কী পরিস্থিতি পার করে এসেছি তা বড়রা জানি। এর তীব্রতা কোনো ধর্মীয় দিবস আসলে মনে বেশি নাড়া দেয়। এসব দেখে আসা বুদ্ধি সম্পন্ন শিশু-কিশোররাও অনেক সময় এসব গল্প করে। ঈদের দিনে সেখানকার স্মৃতি ভুলতে বা শিশু-কিশোরদের ভুলিয়ে রাখতে এ আনন্দ আয়োজনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। কারণ শিশুদের আনন্দই আমাদের আনন্দ।
বালুখালী তাজনিমার খোলার আবদুর রহিম, আলী আকবর, জসিম উদ্দিনসহ একাধিক রোহিঙ্গা জানান, নিজেরা নতুন জামা নিতে না পারলেও চেষ্টা করেছি সন্তানদের ঈদের আনন্দ উপভোগের সুযোগ করে দেয়ার।
মধুর ছরার ‘ডাবল ও’ ব্লকের মাঝি রহিম উদ্দিন ও ‘এফএফ’ ব্লকের মাঝি জমির উদ্দিন বলেন, বৈরী আবহাওয়ার মাঝে ঈদে রোহিঙ্গা শিশুদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে অনেক খুশি রোহিঙ্গারা। আশ্রয়, ঈদের নামাজ ও ঈদ উদযাপনের সুযোগ দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের জন্য মন থেকে দোয়া করেছি আমরা।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। মানবিকতা বিবেচনায় ঈদ সামগ্রী বিতরণসহ সুষ্ঠুভাবে ঈদের নামাজ আদায় করাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া ছিল। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি মক্তবে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান বলেন, টেকনাফে রেজিস্টার ও আনরেজিস্টার মিলে আড়াই শতাধিক মসজিদ ও মক্তবে ঈদ জামাত আদায় করেছে এখানে অবস্থানকারী প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সরকার রোহিঙ্গাদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোও ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেছে। এছাড়া সপ্তাহিক ও মাসিক রেশন বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। কোনো সমস্যা ছাড়াই সকাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মসজিদ ও মক্তবে পর্যায়ক্রমে ঈদের জামাত আদায় করা হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয় বলেও উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক।
সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/পিআর