কাউন্সিলর একরামের মৃত্যুর পর থমকে গেছে মাদকবিরোধী অভিযান

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ পিএম, ২৯ মে ২০১৮

র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের তিনবারের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহতের ঘটনায় পুরো কক্সবাজারে থমকে গেছে চলমান মাদকবিরোধী অভিযান।

শুরু থেকে মাদকবিরোধী হিসেবে পরিচিত হলেও ভুল তথ্য বা অদৃশ্য কোনো কারণে একরামুল হত্যার শিকার হয়েছেন এমন দাবিতে চরম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে পুরো জেলায়। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

এলাকাবাসী ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং পারিবারিক স্বজনদের দাবি, একরামুল কখনও ইয়াবা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের অভিযানে একরাম নিহত হয়েছেন কি-না, তা তদন্তের দাবি করেছেন তারা। এ দাবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও আপলোড করেছেন সদ্য বিধবা হওয়া আয়েশা খাতুন। চারদিকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠায় এক প্রকার থমকে গেছে মাদকবিরোধী অভিযান।

গত শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের নোয়াখালিয়াপাড়ায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর একরামুল হক। তিনি টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়ার মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে। এছাড়াও তিনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের ১৩ বছর দায়িত্বপালনকারী সাবেক সভাপতি, টেকনাফ বাস স্টেশন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও টেকনাফ মাইক্রো শ্রমিক ইউনিয়নের আহ্বায়ক ছিলেন।

অপরদিকে, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হবার ঘটনায় র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে ই-মেইলে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তার বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মোজাহার মিয়া ওরফে আবদুস সাত্তার। বাড়ি টেকনাফ পৌরসভার নাজিরপাড়া। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী, শীর্ষ গডফাদার, তার বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মাদক আইনে মামলা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।

কিন্তু একরামের ভাই এহসানুল হক বাহাদুর জানান, তাদের বাবার নাম মোজাহার মিয়া নয়। টেকনাফ পৌর এলাকায় নাজিরপাড়া নামে কোনো এলাকাও নেই। একরাম কোনো সময় ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে মামলাও নেই।

তিনি আরও বলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের কিছু লোক শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার ভাইকে ডেকে নিয়ে যায়। এ সময় তারা বলেছিল, জমি বিক্রির ব্যাপারে তারা একরামুলের সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু পরে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পাই।

এলাকাবাসী জানায়, টেকনাফ সদর ইউনিয়নে নাজিরপাড়া নামে একটি গ্রাম রয়েছে। যা পৌর এলাকা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। ওই গ্রামে মোজাহার মিয়া নামে এক ব্যক্তির তিন ছেলে চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী। একই এলাকায় একরামুল নামে আরও এক ব্যক্তি রয়েছে, যার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ এবং তার নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য তালিকায় রয়েছে।

একরামের স্ত্রী আয়েশা খাতুন বলেন, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব তার স্বামীকে হত্যা করেছে। এ ঘটনার তদন্ত দাবি করেন তিনি।

টেকনাফ থানা পুলিশের ওসি রণজিত কুমার বড়ুয়া জানান, নিহত পৌর কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দুটি মামলা ছিল। যার একটি মারামারির। অপরটি মাদক আইনে। মারামারির মামলাটি আদালতে শেষ হয়েছে। মাদকের মামলায় তার সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

Ekram-Bhai

এদিকে, একরাম নিহত হবার পর কক্সবাজার জেলাব্যাপী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ।

প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছেন কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র, জেলা যুবলীগের সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। রোববার রাতে লেখা এই চিঠিতে একরামুল হককে একজন ত্যাগী নেতা ও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সঙ্গী হিসেবে বর্ণনা করেন মেয়র মাহবুবুর।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর মতে, নিহত একরাম ও তার পরিবার বরাবরই স্থানীয় ইয়াবা ডনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। তাই একরামের মৃত্যুর উল্লেখ করা কারণটি টেকনাফ তথা কক্সবাজারের মানুষ সহজভাবে নিচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত ভুলটা কি তা পরিষ্কার করা।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিক মিয়া বলেন, প্রায় দু'যুগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। ওই সময়ে একরামুল ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং পরে আওয়ামী লীগে যোগদান করে রাজপথ কাঁপিয়েছে। এমন একজন রাজনৈতিক কর্মী ইয়াবার নামে খুনের শিকার হলেন। অথচ রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া অগণিত ইয়াবা কারবারি বহাল তবিয়তে রয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, একরাম অর্থাভাবে তার বাড়ির নির্মাণ কাজটাই শেষ করতে পারেননি। বকেয়া রয়েছে নিজের সন্তানের স্কুলের বেতনও। এরকম একজন মানুষ ইয়াবা ব্যবসায়ী-এটা হাস্যকর।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার পর চারদিকে সমালোচনার ঝড় উঠায় পুরো কক্সবাজারেই থমকে গেছে মাদক বিরোধী অভিযান। মেয়র মাবু ও একরামের দু'মেয়ের খোলা চিঠি প্রকাশ পাবার পর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে একরাম বিষয়ে খোঁজ নেয়া হয়েছে বলে প্রকাশ পায়। এটি জানার পর সন্তর্পণে পা ফেলছে সংশ্লিষ্ট অভিযানকারীরা। তাই গত দুদিন ধরে কোথাও কোনো অভিযানের খবর আসেনি।

একরামের মৃত্যু বিষয়ে জেলা ব্যাপী শুরু হওয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে দৃষ্টি আকষণ করা হলে র‌্যাব-৭ কক্সবাজারের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. রুহুল আমিন বলেন, যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। যে যার অবস্থান থেকে বিষয়টি নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে যেকোনো অপারেশনকে আমরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করি।

তার মতে, নিহত একরাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি ও ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার। বন্দুকযুদ্ধের পর লাশের পাশ থেকে একটি বিদেশি রিভলবার, পাঁচটি গুলি ও ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।

অভিযান থমকে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি চলমান অভিযান। থমকে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আমরা গোছালোভাবে এগুচ্ছি।

এমএএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।