আইলার ক্ষত কাটেনি ৯ বছরেও
আজ ২৫ মে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আইলার ৯ বছর। ২০০৯ সালের বিধ্বংসী এ ঝড়ের পর থেকে আজও উপকূলজুড়ে খাবার পানির তিব্র সঙ্কট। স্থানীয়দের দাবি বেশিরভাগ নলকূপ নষ্ট। তাই সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি উপকূলীয় এ জনপদের খাবার পানির প্রধান উৎস। তবে বৃষ্টির পানি শেষ হওয়ার পর থেকে তারা পুকুরের পানি ব্যবহার করেন। কিন্তু দিনে দিনে পুকুরের পানিও কমে যাওয়ায় এখন কর্দমাক্ত আর দুর্গন্ধময় পানিই তাদের একমাত্র ভরসা।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ভেটখালী গ্রামের সুষমা মন্ডল ও সুধা রানী জানান, ২০০৯ সালের আইলার পর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের শেখবাড়ির দীঘি থেকে তারা গোটা গ্রীষ্মকালজুড়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতেন। তিন-চার বছর আগে বিদেশি সংস্থা জাইকা’র পক্ষে স্থানীয় ঈশ্বরীপুর ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) রাস্তাজুড়ে পাইপযোগে বসত বাড়ির সামনে পানি টেনে আনার ব্যবস্থা করে। কিন্তু এক বছরের মধ্যে পাইপসহ যাবর্তীয় সরঞ্জামাদী নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন আবারও ওই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। আবার গত কিছুদিন ধরে পুকুরের পানি কমে যাওয়ায় এখন কাদাযুক্ত পানি খেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। গরম বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পানি লবণাক্ত হয়ে যায় বলেও জানান তারা।
উপকূলবাসীর খাবার পানির এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। গভীর-অগভীর নলকূপ সফল না হওয়া, আরএসএফ, পিএসএফগুলো যথাযথভাবে কাজ না করাসহ নানা কারণে তাদের খাবার পানির প্রধান উৎস বর্ষা মৌসুমে সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি। কিন্তু ওই পানি দিয়ে বছরের অর্ধেকটা সময় পার হলেও বাকি সময় তারা খাবার পানির তীব্র কষ্টে ভোগেন।
উপকূলবাসীর খাবার পানির প্রকট সংকট নিরসনে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় এ জনপদে প্রথম পর্যায়ে ৫৭টি পুকুর পুনঃখনন প্রকল্প গ্রহণ হয়েছে। ন্যূনতম ১৯ লাখ থেকে সবোর্চ্চ ৬৮ লাখ টাকা খরচে পানি সংরক্ষণ ও নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ওই প্রকল্পের আওতায় জেলা পরিষদের আওতাধীন সরকারি পুকুরসমুহ পুনঃখননের প্রকল্প গৃহীত হয়।
তবে মহতী এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরুতে বিপত্তি ঘটেছে জেলা পরিষদের পুকুর দাবি করে প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া কিছু পুকুরের মালিকানা স্থানীয়রা দাবি করায়। এমন ঘটনার সূত্র ধরে ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ পাওয়া সত্ত্বেও ভুরুলিয়ার কাটিবারহল গ্রামে ১৬১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন পুকুরটির খনন কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলা পরিষদ ওই পুকুর নিজেদের দাবি করে পুনঃখননের প্রস্তাবনা পাঠালেও কয়েকজন পুকুরটি তাদের দাবি করেছে।
উপজেলা সহকারী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় প্রথমে ১৫টি পুকুর পুনঃখনন করা হবে। প্রথম দুইটি খনন করতে গিয়ে পুকুরের মালিকানা নিয়ে জেলা পরিষদের সঙ্গে স্থানীয়দের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। একটি পুকুরের খনন কাজ চলছে।
জনস্বাস্থ্য বিভাগের সাতক্ষীরা নিবার্হী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম জানান, জেলা পরিষদের মালিকাধীন পুকুর, দীঘি ও জলাকার পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত জেলায় ৫৭টি পুকুর খনন করা হবে। চলতি বছর ৩০টি খনন করা হবে। ইতোমধ্যে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০টি পুকুরের টেন্ডার হয়ে গেছে।
এদিকে ভোলায় একে একে ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও সে দিনটির কথা আজও ভুলতে পারেনি উপকূলের মানুষ। এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে। ঝড়ে স্বজন হারানো মানুষের কান্না যেন আজও শোনা যায়। বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সে কথা মনে করলে আজও আতঁকে ওঠেন। মুহূর্তের মধ্যেই বিস্তীর্ণ জনপদ ধ্বংসলীলায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
কলাতলীর চরের বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, সাত ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়। মুহূর্তের মধ্যেই পানিতে ঘর-বাড়ি তলিয়ে যায়। সে ঝড়ের কথা কোনো দিনই ভোলার নয়।
দূর্গম ঢালচরের মৎস্য ব্যবসায়ী মাহাবুব বলেন, ওই ঝড়ের সময় আমরা কেউ ঝড়ের পূর্বভাস পাইনি। যার ফলে এখানে ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হয়েছে। ঝড়টি মুহূর্তের মধ্যেই সব উপড়ে ফেলে দেয়। জেলেদের কয়েকশ' নৌকা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উপকূলের মানুষের জন্য আজ পর্যন্ত সাইক্লোন শেল্টার ও মাটির কিল্লা নির্মাণ করা হয়নি। এখনও মানুষ পাচ্ছে না ঝড়ের পূর্বাভাস।
২০০৯ সালের ২৫ মে এ দিনে ঘূর্ণিঝড় আইলা ভোলার উপকূলে আঘাত হানে। এতে মুহূর্তের মধ্যে ভোলা সদর, মনপুরা ও চরফ্যাশন উপজেলায় ৩০ হাজার ঘড়-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। সেখানকার ৪০ গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়। জলোচ্ছ্বাস হয় ছয়-সাত ফুট উচ্চতায়। পানিতে ভেসে যায় কয়েকশ মাছের ঘের। বিনষ্ট হয় হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। ঝড়ে প্রাণ হারান ১৮ জন। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ জনপদ ও মানুষের ঘর-বাড়ি।
আকরাম/তপু/এফএ/এমএস