লাশ প্রতি ৪ হাজার টাকা নেন তিনি!

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ফরিদপুর
প্রকাশিত: ০৫:১১ পিএম, ২০ মে ২০১৮

হাসপাতালের কেউ না হয়েও তিনি সর্বেসর্বা। কোনো লাশ হাসপাতাল থেকে বের করতে হলে তাকে টাকা দিতেই হবে। তা না হলে লাশ বের হবে না।

টাকা না দিলে লাশের ময়নাতদন্ত করতে দেয়া হবে না। এমন নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে শোকাহত স্বজনদের হয়রানি করাই তার দৈনন্দিন কাজ। হয়রানি থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়েই টাকা দিয়ে লাশ নেন স্বজনরা।

সবার চোখের সামনে মৃতের স্বজনদের জিম্মি করে এই অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পদ-পদবিহীন এক ব্যক্তি। তার নাম ফেলা (৪০)। হাসপাতালে তার কোনো পদবি না থাকলেও তার হুকুম ছাড়া হাসপাতাল থেকে কোনো লাশ বের হয় না।

জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফেলার কোনো পদ-পদবি নেই। নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিও নয়। অথচ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুপারসহ সবাই তাকে মান্য করে চলে। লাশ নিয়ে তার এই টাকা হাতানোর খবর সবার জানা। কিন্তু কেউ তাকে কিছু বলে না।

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের দাসপাড়ার বাসিন্দা ইসলাম শেখ (৬৫) শনিবার বিকেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন।

গুরুতর আহত ইসলাম শেখকে প্রথমে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। রাতে তার অবস্থার অবনতি হলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রাত ২টার দিকে ইসলাম শেখ মারা যান।

রোববার সকালে ইসলাম শেখের লাশ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। বাড়ি থেকে স্বজনরা ইসলাম শেখের লাশ আনতে গেলে হাসপাতালের ফেলা ৪ হাজার টাকা দাবি করেন। যে কথা সেই কাজ। ৪ হাজার টাকা আদায় করে লাশ হস্তান্তর করে ফেলা।

বাগাট ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য শওকত আলী মোল্লা জানান, ইসলাম শেখের স্বজনদের সঙ্গে রোববার সকালে হাসপাতালে লাশ আনতে আমিও যাই। সেখানে যাওয়ার পর মর্গের দায়িত্বে থাকা ফেলা নামের এক ব্যক্তি টাকা না দিলে লাশের ময়নাতদন্ত হবে এ ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা নেয়। মারা যাওয়া ইসলাম শেখ দরিদ্র ব্যক্তি। ওই টাকা আমার কাছ থেকে দিয়ে লাশ নিয়ে বাড়ি আসি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরের হারোকান্দির পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা ফেলা মূলত একজন ভ্যানচালক। দীর্ঘদিন ভ্যানে করে লাশ আনা-নেয়া করতে করতে সে এখন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের বড় কর্তা বনে যান। তার হুকুম ছাড়া মর্গ থেকে কোনো লাশ বের করা যায় না।

স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ১০ বছর ধরে ফেলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ১০ বছরে তিনি লাশ ছাড়ানোর টাকা দিয়ে লাখপতি বনে গেছেন। সেই সঙ্গে বাড়ি-ঘর নির্মাণ, জমি-জমা কিনে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন ফেলা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মর্গের লাশ ছাড়ানোর টাকা শুধু ফেলা একাই খায় না, এই টাকার ভাগ হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটেও যায়। বিশেষ করে ওয়ার্ডের দায়িত্বে যারা থাকে তারাই এ টাকার বড় একটা অংশ পায়।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচ্ছন্নকর্মী প্রদীপ জামাদার বলেন, সম্প্রতি চিঠি দিয়ে হাসপাতালের মর্গের দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। কিন্তু ফেলার দাপটে মর্গের কাছেই যেতে পারছি না।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান জানান, ফেলা হাসপাতালের নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী নয়। কিভাবে যে তিনি এই কাজে রয়েছে বুঝতে পারছি না।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ফেলা হাসপাতালের কেউ নয়। তবে কেন ফেলা মর্গের দায়িত্ব পালন করছেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ফেলা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন।

হাসপাতাল থেকে লাশ নেয়ার সময় স্বজনদের কাছ থেকে ফেলার টাকা নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, টাকা নেয়ার কথা নয়। তবে নিয়ে থাকলে অন্যায় করেছেন ফেলা।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা.কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, অপমৃত্যু হলে ময়নাতদন্ত করতে হয়। এছাড়া ময়নাতদন্তের প্রয়োজন নেই। ময়নাতদন্তের নামে ও হাসপাতাল থেকে কোনো লাশ নেয়ার সময় টাকা নেয়ার নিয়ম নেই।

স্বজনদের কাছ থেকে লাশ প্রতি ৪ হাজার টাকা নেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।

জানতে চাইলে এ বিষয়ে অভিযুক্ত ফেলা বলেন, লাশ ওঠা-নামা করানোর জন্য মানুষ আমাকে খুশি হয়ে কিছু দেয়। আমি এর বেশি টাকা কারও কাছ থেকে নিই না।

এএম/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।