বোয়ালমারীর গ্রামে তৈরি হচ্ছে জামদানি

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ফরিদপুর
প্রকাশিত: ০৮:১২ এএম, ২০ মে ২০১৮

বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ স্থান দখল করে আছে ঐতিহ্যবাহী মসলিন জামদানি শাড়ির নামটি। রেশমি সুতা থেকে তৈরি মসলিন জামদানির তাঁত গত বেশ কয়েক বছর ধরে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নে সোতাসী-মজুরদিয়া গ্রামে কাজ শুরু করেছে।

কোনো প্রকার সরকারি কিংবা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোগতারা তাঁত বসিয়ে মসলিন জামদানি তৈরি করতে শুরু করেছে। রমজানের ঈদকে সামনে রেখে এই কারিগরদের ব্যস্থতা বেড়েই চলেছে। দিন রাত চলছে জামদানির তৈরির কাজ।

Faridpur

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে জামদানি ঘরে শুরু হয় হাক-ডাক। আসছে উৎসবকে সমানে রেখে নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে উঠে জামদানি পাড়ার কারিগররা। নিজস্ব তাঁতে বোনা প্রতিটি জামদানি শাড়ি ভাজে ভাজে নতুনের গন্ধ। দেশীয় পণ্যে নিত্য নতুন গবেষণা আর ক্রেতাদের চাহিদায় অনেক জনপ্রিয় এই বেনারশী জামদানি শাড়ি।

তবে বর্তমান বাজারে সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, কারিগর আর মেশিনারি সমস্যাসহ নানা বিষয় নিয়ে অভিযোগ রয়েছে তাঁত শিল্পীদের।

Faridpur

জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নে গত ৭/৮ বছর আগে সোতাশী ও পার্শ্ববর্তী মজুরদিয়া গ্রামের কয়েকজন কিশোর বেঁচে থাকার তাগিদে কর্মের সন্ধানে নারায়ণগঞ্জ জেলার জামদানি পল্লীতে কাজ নেয়। সেখানে দুই বছর ধরে কাজও করেন তারা। সেখানে প্রথমে সামান্য বেতনে কাজ করতে থাকে, কাজ শেখার পর ৪/৫ হাজার টাকা উপার্জন শুরু করে। এই টাকা দিয়ে তারা নিজেদের এবং বাড়ির সংসার কোনোমতো চালাতে থাকে। সেই থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নিজেরা তাঁত স্থাপনের মাধ্যমে অধিক উপার্জনের। সেই অনুযায়ী কেউ কেউ বাড়ি ভাড়া নিয়ে নারায়ণগঞ্জ এর জামদানি পল্লীতেই তাঁত বসানোর চেষ্টা করলে বাঁধ সাধেন অন্যান্য তাঁত মালিকরা।

এতে অনেকের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও হাল ছাড়েননি জেলার বোয়ালমারীর মো. আবু নাছের (১৯) ও তৌহিদ বিশ্বাসরা। ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। লালিত স্বপ্ন প্রতিষ্ঠায় মনোবল আর জিদকে কাজে লাগিয়ে একটি তাঁত স্থাপন করে মসলিন জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন তৌহিদ বিশ্বাস। নিজের ভাই ইউসুফ বিশ্বাসসহ কয়েকজনকে শিক্ষা দেয় তাঁত চালানোর। এরই মধ্যে পাঁচটি তাঁত স্থাপন করেছেন তিনি।

Faridpur

একইভাবে ওই গ্রামের আবু নাছের ও স্ত্রী আল্লাদী বেগম ও তার ভাইকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আটটি তাঁত স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছেন। যার প্রতিটি তাঁত থেকে দুজন কারিগরের মাধ্যমে মাসে পাঁচটি মসলিন জামদানি শাড়ি উৎপাদন করে।

আবু নাছের জানান, প্রত্যেকটি শাড়ির মূল্য সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রয় করা হয়। প্রত্যেকটি শাড়িতে ৬ থেকে ৮শ কোনোটায় ১৫শ থেকে ২০ হাজার টাকার সুতা প্রয়োজন হয়। শাড়ির ওজন হয় দুই থেকে আড়াইশ গ্রাম।

Faridpur

একইভাবে উপজেলার মজুরদিয়া এলাকার আলী আকবর জানান, গত ৪/৫ বছর হলো বাড়িতে একটি টিনের ঘর তুলে ৬টি তাঁত বসিয়েছি। প্রতিটি তাত থেকে ৪ থেকে ৫ দিনে একটি শাড়ি তৈরি করা যায়। তিনি জানান, বর্তমান বাজারে সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণের দামবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, কারিগর আর মেশিনারি সমস্যাসহ নানা বিষয়ে সমস্যা রয়েছে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের।

উদ্যোগতারা জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতি ভরি সুতা ৬০ থেকে ৮৫ টাকায় ক্রয় করতে হয়। খরচা বাদে বিক্রিত শাড়ির লাভের টাকার অর্ধেক কারিগরের বাকি অর্ধেক থেকে হেলপারের বেতন দিয়ে যা থাকে তা মালিকের। কারিগরদের অনেকেই শিশু শ্রেণির হলেও স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্ব-উৎসাহেই স্কুল সময়ের আগে পরে কাজ করে থাকে। ক্ষুদে কারিগর জিহাদ বিশ্বাস (১০), হৃদয় (১৪), জাহিদ (১০), আরশাদ (০৮), সাগর বিশ্বাস (১০) ও দ্বীন ইসলামের (১২) সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, কাজ করতে ভালোই লাগে। উপার্জিত অর্থ লেখাপড়াসহ সংসারের কাজে লাগাবে বলেও জানায় তারা।

Faridpur

উদ্যোগতা তৌহিদ বিশ্বাস জানান, উৎপাদিত শাড়ি বিদেশে চলে যায়। আমরা নারায়ণগঞ্জের ফড়িয়াদের কাছে তাদের নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করি। তিনি দাবি করেন, এ শাড়ির স্থানীয় বাজার সৃষ্টি করা গেলে অনেকেই এ পেশায় আসবে।

তৌহিদ বিশ্বাস আরও জানান, এ ব্যবসা পরিচালনা করতে তাদের বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে চড়া সুদে ঋণ করতে হয়েছে। ফলে পেশাটি লাভজনক হলেও তাদের (উদ্যোগতাদের) লাভের মুখ দেখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। উদ্যোগতারা এ শিল্পের প্রসারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের প্রতি আহ্বান জানান।

স্থানীয় সাতৈর ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান জানান, ফরিদপুরে তাঁত শিল্প কারিগরদের হাতে তৈরি বেনারশী জামদানির চাহিদা বেশ রয়েছে। তবে সময়মতো কারিগর ও অর্থের অভাবে এই শিল্পর সঙ্গে জড়িতরা অন্য পেশায় যাচ্ছে। তার দাবি, প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিলে এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।