দাফনের ১১ দিন পর বেরিয়ে এলো খালেক

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৮:৫৪ পিএম, ০৩ মে ২০১৮

কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও কলেজ গেইট ব্রিজ এলাকার খালপাড় থেকে উদ্ধার হওয়া বস্তাবন্দি মরদেহটি পরিচয় শনাক্তের পর দাফন করা হয় ২১ এপ্রিল। সদরের ঝিলংজা ইউপির খরুলিয়া ঘাটপাড় এলাকার মৃত হাজী আবু ছৈয়দের ছেলে মু. আবদুল খালেক (২৮) হিসেবে স্বজনরা তাকে গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দাফনও করেছে।

কিন্তু দাফনের ঠিক ১১ দিনের মাথায় খালেককে জীবিত উদ্ধার করে এনেছে কক্সবাজার জেলা ডিবি পুলিশের একটি দল। বৃহস্পতিবার ভোররাতে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার বার আউলিয়া এলাকা থেকে আবদুল খালেককে আটক করে পুলিশ। কক্সবাজার ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মানস বড়ুয়া তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।

মানস বড়ুয়া জানান, ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টার দিকে মরদেহটি উদ্ধার হবার দু’দিনের মাথায় খালেকের পরিবারের লোকজন কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে এসে তাকে খালেক হিসেবে শনাক্ত করে লাশ গ্রহণের পর নিয়ে যান। এ ঘটনায় কক্সবাজার সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয় (৬১/২০১৮)। স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে খালেক খুন হয়েছেন সন্দেহ করায় ৫৪ ধারায় খালেকের স্ত্রী জোবাইদা বেগম, স্ত্রীর বড় বোন মোবারকা ও ভগ্নিপতি ফারুককে পুলিশ সন্দেহজনকভাবে আটক করে ২৩ এপ্রিল আদালতে উপস্থাপন করে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠান।

তিনি আরও জানান, এরপর মামলাটি তদন্তাধীন ছিল। এর ভেতর গত তিন দিন আগে খালেকের ব্যবহৃত সিম থেকে একটি কল আসে ভাই আবদুল্লাহর কাছে। সেই বিষয়টি স্থানীয় মেম্বারকে জানালে মেম্বার ডিবিতে এসে নম্বরটি দেয়। তা পেয়ে এর ক্লু উদঘাটনে মাঠে নামে ডিবি পুলিশ। প্রযুক্তির মাধ্যমে খালেকের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরটি ট্র্যাক করা হয়। দাফনের আগে থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিমটি সচল করা হয়েছে এবং সরোয়ার নামের এক যুবক তা ব্যবহার করছে। সরোয়ার খালেকের আত্মীয়। তার কাছ থেকে খালেকের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পেরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।

তাকে সামনে এনে বৃহস্পতিবার বিকেলে এসপি কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে খালেক জানিয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের পর ১৪ এপ্রিল তিনি সীতাকুন্ড চলে গিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন। এসময় ৬-৭ দিন তার ব্যবহৃত মুঠোফোনটিও বন্ধ করে রাখে। তাই কক্সবাজারে তাকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই তিনি জানতে পারেননি। কিন্তু দাফনের পরের দিন তার আত্মীয় সরোয়ারের মাধ্যমে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দাফন করা হয়েছে জানার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন খালেক। এরপর তিনি নিজ থেকে তার ভাই (মৃত খালেক হিসেবে শনাক্তকারী) আবদুল্লাহকে কল করলে তাকে চিনে না বলে ফোন কেটে দেয়। এতে কিংকর্তব্যমিমূঢ় খালেক আজকালের মধ্যে এলাকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর আগেই পুলিশ তাকে আটক করে কক্সবাজার নিয়ে আসে।

এদিকে মৃত খালেককে জীবিত আটক করে আনার খবরটি ছড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সবাই খালেককে এক নজর দেখতে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ডিবি অফিসে ভিড় জমান।

তাকে মৃত খালেক হিসেবে শনাক্তকারি তার ছোট ভাই আবদুল্লাহ এবার জীবিত খালেককেও তার ভাই হিসেবে শনাক্ত করেছেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মরদেহটি পরখ করে খালেকের দেহে থাকা বেশ কিছু চিহ্ন মিলে যাওয়ায় সবাই তাকে খালেক হিসেবে শনাক্ত করেছিলাম।

পেশায় রাজমিস্ত্রি খালেকের সঙ্গে সদরের খুরুশকুল তেতৈয়ার নতুন ঘোনারপাড়ার ছৈয়দুল হকের মেয়ে জোবাইদার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় গত বছরের নভেম্বর মাসে। পারিবারিক মনোমালিন্যে ১৪ এপ্রিল শ্বশুরালয়ে গেলে সেখানে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে ১০ কিলোমিটার দূরে ঈদগাঁও নিয়ে ফেলে দেয়া হয় বলে দাবি করে মামলা করা হয়।

ঝিলংজা ইউপির খালেকদের এলাকার সদস্য আবদুর রশিদ জানান, ২১ এপ্রিল সদর হাসপাতাল মর্গে যে মরদেহটি খালেক বলে শনাক্ত হয় তার অবয়ব, চুল ও শরীরের বিভিন্নাংশ দেখে তাকে ভাই বলে শনাক্ত করেছিলেন আবদুল্লাহ ও অন্য ভাইয়েরা। কিন্তু এখন তাকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। পারিবারিক কলহ ও স্বামী-স্ত্রী ও স্ত্রীর পুরোনো প্রেমিকের বাকবিতণ্ডা মুঠোফোনে থাকা রেকর্ডে খালেককে হত্যার হুমকি ছিল। তাই আসলে খালেক হত্যার শিকার হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া মরদেহটি তখন ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা থাকায় মাথা, বুক ও শরীরের নানা অংশ কাটাছিল। এ জন্য তাকে নেড়েচেরে দেখার সুযোগ ছিলনা।

ঝিলংজা ইউপি চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, এটি আজব ঘটনা। এরপরও খালেক জীবিত ফিরে এসেছে এটাই সান্ত্বনা। এখন দেখার বিষয় খালেক হিসেবে যে মরদেহটি কবরস্থ হয়েছে সে হতভাগাটা আসলে কে?

ওসি মানস বড়ুয়া বলেন, খালেককে ডিবি কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। দাফন করা যুবকটি টেকনাফ এলাকার জনৈক সাইফুলের বলে দাবি উঠেছে। ধাঁ ধাঁ কাটাতে কাজ করছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

কক্সবাজার সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ উদ্দিন খন্দকার জানান, দাফন করা খালেক যেহেতু জীবিত ফিরে এসেছে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হবে। আদালতের সিদ্ধান্ত মতো পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারান্তরিণ তিনজনের কি হবে জানতে চাইলে, ওসি বলেন-সেদিন তাদের বিষয়ে অভিযোগ উঠায় তা তদন্তের স্বার্থে ৫৪ ধারায় চালান দেয়া হয়েছিল। এখন যেহেতু সেই অভিযোগের ভিকটিম জীবিত ফিরে এসেছে তখন তাদের ব্যাপারেও আদালত সিদ্ধান্ত দেবে।

উল্লেখ্য, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঈদগাঁও কলেজ গেইট ব্রিজের পশ্চিমে বিমান মৌলভীর ইটভাটা দক্ষিণাংশে লাগোয়া খালে ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় ভাসমান অবস্থায় পাটের বস্তাবন্দি অবস্থায় অজ্ঞাত হিসেবে খালেদ’র লাশটি পাওয়া যায়। বিকেলে স্থানীয় কিছু সবজি চাষি ক্ষেতে কাজ করে হাত পরিষ্কার করতে গিয়ে ভাসমান পাটের বস্তা দেখতে পেয়ে তা টেনে কিনারে আনেন। বস্তার একপাশ ছিড়ে ভেতরে লাশ দেখে চিৎকার দেন তারা। খবর পেয়ে ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই শাহাজ উদ্দীন ও এএসআই মহিউদ্দীন ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে সুরহতাল করার পর কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। সেখানে শুক্রবার রাতে স্বজনরা গিয়ে তাকে খালেক বলে শনাক্ত করেন। পরিচয় শনাক্ত হচ্ছিল না দেখে মরদেহটি শনিবার বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের জন্য আঞ্জুমন আল ইত্তেহাদকে দেয়া হয়েছিল।

এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।