বিষপান করা মেয়েটিকে নিজের মেয়ে ভেবেছিলেন হাসান

জিতু কবীর
জিতু কবীর জিতু কবীর , নিজস্ব প্রতিবেদক রংপুর
প্রকাশিত: ০১:৩৬ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

‘রাত ১২টার দিকে খবর পেলাম নগরীর বাবুখাঁ এলাকায় একটি মেয়ে বিষপান করেছে। দিকবিদিক না বুঝে গাড়ি নিয়ে ছুটে গেলাম ওই বাড়িতে। গিয়ে দেখি বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। ছোট একটি মেয়ে, মধ্যবয়সী এক নারী আর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকা আনুমানিক ২০-২২ বছর বয়সের ওই মেয়েটি। নিজের মেয়ের কথা মনে পড়লো তখন। মধ্যবয়সী ওই নারীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিজেই মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে তিনতলা থেকে নামিয়ে গাড়িতে ওঠাই। মেডিকেলে পৌঁছে ওষুধ কেনা থেকে শুরু করে ডাক্তার দেখানোসহ সব কাজ নিজেই করি। সৃষ্টিকর্তার রহমতে বেঁচে যায় মেয়েটি।’

এমন সুখ-দুঃখের হাজারো স্মৃতি যা মনে হলে নিজেকে গর্বিত মনে করেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক হাসান আলী (৪৫)। রাত-বিরাতের ঝড়-তুফান, রোদ-বৃষ্টি কিংবা শীতের ঘন কুয়াশায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে এভাবেই তিনি ছুটছেন গত ১৪ বছর ধরে।

পাওয়া-না পাওয়ার হিসাবের মাঝেও কিছু কিছু গল্পের শুরুটা যেমন হয় হাসান আলীদের দিয়ে তেমনি রোগীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজেরও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার কাহিনীটাও হয়ে ওঠে রোমহর্ষক।

জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে হাসান আলী জানান, ঘটনাটি ২০১৪ সালের প্রথম দিকের। ওই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান দেশজুড়ে। হরতাল-অবরোধে স্থবির সবকিছু। এরইমধ্যে সংকটাপন্ন এক রোগীকে নিয়ে ছুটছিলেন রাজধানীর দিকে। রাত তখন ৩টা। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সামনের মহাসড়কে পৌঁছে দেখলেন সারিবদ্ধ করে রাখা বড় বড় পাথর আর গাছের ডাল দিয়ে আটকানো হয়েছে পথ। গাড়ি থেকে নেমে সহকর্মীসহ নিজ হাতে পাথর সরাচ্ছিলেন। এমন সময় ধারালো অস্ত্র নিয়ে মুখোশধারী ৮-১০ জন লোক এগিয়ে আসছিলেন তাদের দিকে। বুঝতে পারলেন ওরা ডাকাত দল। দৌড়ে গাড়িতে উঠে যখনি সামনের দিকে এগুচ্ছিলেন তখন এলোপাথাড়ি মারের আঘাতে ভেঙে পড়ে গাড়ির সব কাচের জানালা। ধারালো ছোরার আঘাত এসে পড়ে তার ঘাড়ে। রোগীর এক স্বজনের পেটে যখম হয় গুরতর। মনে হয়েছিল আজই বুঝি জীবনের শেষ দিন।

হাসান বলেন, সেদিন নিজের কথা ভাবিনি। রোগী ও সঙ্গে থাকা লোকজনদের কথা ভেবে রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডালের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে আসি। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করি আমার ঘাড় বেয়ে রক্ত ঝরছে। প্রচণ্ড ব্যাথা আর রক্তমাখা শরীর নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে আঘাতপ্রাপ্ত সবাই চিকিৎসা নিই। সময়মতো না পৌঁছালে হয়তো সেদিনের রোগীটিও বাঁচতো না।

রোগীর জীবন বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে যেমন ভালো লাগে তেমনি কিছু ঘটনা ভিষণ কষ্টও দেয় হাসান আলীকে।

তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে রাতের বেলা কিছু ফোন আসে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তাদের ফোন বন্ধ হয়ে পাই। কোনোভাবেই আর যোগাযোগ করতে না পেয়ে ফিরে আসি।

jagonews24

এমন কেন হয়? জানতে চাইলে হাসান বলেন, কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক এমন করে মজা পায়। এছাড়াও অনেক সময় সন্তান প্রসবের কারণেও আমাদের ডাকে। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর হয়তো সন্তান প্রসব হয় আর তখন টাকা দেয়ার ভয়ে ফোন বন্ধ করে রাখেন। কিংবা কেউ মারা গেলেও এমনটা ঘটে। ফলে ফিরে আসি আর যাওয়া-আসার তেল খরচের টাকা তখন নিজেকেই বহন করতে হয়।

১৪ বছর চাকরি জীবন পার করে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব আর করেন না হাসান আলী। দুই-একজন হয়তো এমন করে মজা পান কিন্তু নিজেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলে হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন, যখন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটা গল্পের নীরব সাক্ষী হয়ে ওঠেন তিনি।

এফএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।