১৪ বছরে ৪ হাজার রোগীকে সুস্থ করতে ছুটেছেন ইউনুছ
হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে এক মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়েছে। আবার কোনোদিন রাতে ঘুমিয়ে আছি ঠিক তখনি ফোন, রোগী নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে। এমন সব মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অ্যাম্বুলেন্স চালক মোহাম্মদ ইউনুছ ১৪ বছর ধরে মানবসেবায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। এ পেশাকে মানবসেবার অংশ হিসেবেই দেখছেন বয়সে তরুণ এ অ্যাম্বুলেন্স চালক।
১৪ বছর ধরে সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়েজিত খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক মোহাম্মদ ইউনুছ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তার চাকরি জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন জাগোনিউজের কাছে।
২০০৪ সালের দিকে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে যোগদান করেন মোহাম্মদ ইউনুছ। ২০০৮ সালের শেষ দিকে সেখান থেকে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে বদলি হয়ে আসার পর গত দশ বছর ধরে এখানেই কর্মরত আছেন।
গেল বছরের শেষ দিকে অভিভাবকহীন এক বৃদ্ধাকে চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা প্রদানের স্মৃতিচারণ করে অ্যাম্বুলেন্স চালক মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, মুমূর্ষু এক বৃদ্ধা রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে যাওয়ার মতো কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না। কোনো উপায় না পেয়ে তাকে চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানোসহ নিজের টাকায় ওষুধও কিনে দিতে হয়েছিল। পরে তাকে কোনো প্রয়োজন হলে জানানোর জন্য নিজের মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে আসেন মোহাম্মদ ইউনুছ। দুই মাস পরে হঠাৎ একদিন অবাক করে ওই বৃদ্ধা তার সঙ্গে দেখা করতে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে আসেন। বিষয়টি তাকে এখনও আবেগাপ্লুত করে জানিয়ে ইউনূছ বলেন, তিনি সেদিন আমাকে টাকাও ফেরত দিতে চেয়েছিলেন।
চাকরি জীবনে গত ১৪ বছরে প্রায় চার হাজার রোগী পরিবহনের কথা জানিয়ে ইউনুছ বলেন, রোগী পরিবহনের সূত্র ধরে অনেকেই এখন আত্মীয় হয়ে গেছে। অনেকেই বিভিন্ন সময় ফোনে বা দেখা করে খোঁজ-খবর নেয়। এসব দেখে নিজের দিবারাত্রি পরিশ্রমের স্বার্থকতা খুঁজে পাই। মনে হয় অ্যাম্বুলেন্স চালক হয়ে খুব একটা ভুল হয়নি। স্ত্রী-সন্তানকে সময় দিতে না পারার কষ্টটা তখন সুখস্মৃতি হয়ে দেখা দেয়। সময়ের ব্যাবধানে স্ত্রী-সন্তানদের বাইরে রোগীরাই হয়ে উঠেছে স্বজন জানালেন ইউনুছ।
তার অ্যাম্বুলেন্সেই অনেক মুমূর্ষু রোগী মারা গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তার মৃত্যু হলে কষ্ট পাই। তবে সেই কষ্টটা নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি।
২০১৭ সালের প্রথম দিকে খাগড়াছড়ির আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে পাথর বোঝাই ট্রাকচাপায় শিশুসহ ৭ জন নিহত ও ১০ জন আহত হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে আহত ও নিহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসা এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি মনে হলে এখনও আতকে উঠি। সেদিন রোগী ও স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে দুইটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও একটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন ধরে। যেটা সচল আছে সেটা রোগী পরিবহনের উপযোগী নয় জানিয়ে মো. ইউনুছ বলেন, তবু রোগীর জীবন বাঁচাতেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসতে হয়। এজন্য তিনি রোগীদের উন্নত চিকিৎসার কথা বিবেচনা করে নতুন অ্যাম্বুলেন্স দাবি করেন কর্তৃপক্ষের কাছে।
খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নয়ন ময় ত্রিপুরা বলেন, আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমরা যেমন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করি, তেমনি এ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. ইউনুছও মুমূর্ষু রোগীকে অন্য হাসপাতালে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাকে দিন-রাত এ কাজে ছুটতে হয় নিজের পরিবার-পরিজনকে রেখেই।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এমএএস/পিআর