সাজা ছাড়াই বছরের পর বছর কারান্তরীণ ওরা ১৪ জন
হাফেজ আহমদ মিয়ানমারের মংডুর আকিয়াবের মাইদি এলাকার আবুল হোসাইনের ছেলে। ২০০০ সালের ৫ অক্টোবর অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় টেকনাফে আটক হন তিনি। এ ঘটনায় টেকনাফ থানায় পাসপোর্ট আইনে মামলা করা হয়। আদালতের দেয়া দণ্ডে ৬ অক্টোবর ২০০০ সাল থেকে ২০০১ সালের ১৮ জুলাই তার সাজা ভোগের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু তিনি এখনও কারান্তরীণ রয়েছেন। ৩৫ বছর বয়সে কারাগারে ঢুকে আদালতের নির্দেশে ১০ মাস সাজা খাটলেও দীর্ঘ ১৮ বছর অকারণে কারাভোগ করে তিনি এখন মধ্য বয়সে এসে দাঁড়িয়েছেন।
শুধু তিনি নন, তার দেশেরই এক নারীসহ আরও ১৩ জন একইভাবে সাজা ভোগের পর এক বছর থেকে এক যুগ ধরে বিনাকারণে কারাগারের অন্ধ প্রকোস্টে দিনযাপন করছেন। তারাও পাসপোর্ট আইনসহ বিদেশী নাগরিক আইনে অভিযুক্ত হন।
কক্সবাজার কারা সূত্রের তথ্যমতে, অভিযুক্তদের মাঝে মিয়ানমারের মংডুর আকিয়াবের বদলাপাড়ার খলিলুর রহমানের ছেলে আবদুর রহিম (৩৮) ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর কারান্তরীণ হয়ে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে সাজার মেয়াদ শেষ করেন। মংডুর ফকিরাবাজার এলাকার মৃত ইউছুফ আলীর ছেলে আলী আকবর (২৮) ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ঢুকে সাজা শেষ করেন ২০০৫ সালের মার্চে। বুচিদংয়ের জব্বারপাড়ার মু. ইউনুছের ছেলে মো. সেলিম (৩২) ২০০১ সালের নভেম্বরে কারান্তরীণ হয়ে সাজা শেষ করেন ২০১১ সালের মে মাসে। একই এলাকার সাব্বির রহমানের ছেলে মুহাম্মদ রফিক (৩০) ২০০৭ সালের মে মাসে কারান্তরীণ হয়ে সাজা শেষ করেন ২০১১ সালের জুলাই মাসে। মংডুর পোকখালীর হাবিব উল্লাহর ছেলে বশির আহমদ (২৯) ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ঢুকে সাজা শেষ করেন ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে। আকিয়াব বলিবাজার এলাকার বসরের ছেলে নুরুল আমিন (২৪) ২০০৯ সালে কারান্তরীণ হন আর সাজা শেষ করে ২০১৪ সালে। বুচিদংয়ের হ্নীলা এলাকার মৃত মুজিবুরের ছেলে রাসেল (৪৫) ২০১৬ সালের অক্টোবরে কারান্তরীণ হয়ে সাজা শেষ করেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বর। একই এলাকার ইয়ং চয়ং পাড়ার আবদু শুক্কুরের স্ত্রী খতিজা (৫০) ২০১৭ সালের জানুয়ারি কারান্তরীণ হয়ে একই বছরের সেপ্টেম্বরে কারাভোগের মেয়াদ শেষ করে। মংডুর তাতুইং গ্রামের মৃত মংচিং মারমার ছেলে আবুচিং মারমা (২২) ২০১৭ সালের মে মাসে কারান্তরীণ হয়ে একই বছরের জুলাই মাসে সাজাভোগ শেষ করেন। রাখাইন স্টেটের মমবা গ্রামের ওমারিন মিউ মারমার ছেলে হিং থাই নাই মারমা (২৪) ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কারান্তরীণ হয়ে একই বছরের নভেম্বরে সাজাভোগের মেয়াদ শেষ করেন। মিয়ানমারের বুচিদং মায়ুকং ওরফে মং কং মারমার ছেলে নিতওয়া (৫০) ২০১৩ সালের নভেম্বর কারান্তরীণ হয়ে ২০১৭ সালের জুনে সাজার শেষ করেন। পলোয়া খায়ংপল্লীর মৃত লেচং এর ছেলে হেইটং (৪৫) ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে কারান্তরীণ হয়ে ২০১২ সালের জানুয়ারি সাজা শেষ করেন আর কেপ্রু এলাকার চউইং রাখাইনের ছেলে চিং অং রাখাইন ২০০৩ সালে কারান্তরীণ হয়ে ২০০৯ সালের অক্টোবরে সাজা শেষ করলেও এখনও কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি রয়েছেন।
তথ্যমতে, কক্সবাজার জেলা কারাগারে এমনিতেই ধারণ ক্ষমতার পাঁচগুণ বন্দির চাপে রয়েছে। তার উপর সাজাভোগের পরও বছরের পর বছর এসব বন্দিদের রাখতে বাধ্য হওয়ায় অন্যদের জন্য এটি ভোগান্তি স্বরূপ। কারা কর্তৃপক্ষের হিসেবে প্রতি বছর শুধু আহার সংস্থানে এ ১৪ বন্দির পেছনে সরকারে খরচ হয় প্রায় সোয়া ৪ লাখ টাকা। এর চেয়ে বড় কথা হলো মানুষ হিসেবে তাদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. বজলুর রশিদ আখন্দ জানান, তাদের কারভোগের মেয়াদ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে মিয়ানমারে পত্র পাঠানো হয়। কিন্তু এদের গ্রহণে মিয়ানমার কোনো ধরণে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এরা ছাড়াও তাদের দেশি আরও বেশ কয়েকজন বন্দি কারাগারে ছিলেন। তাদের স্বজনরা যোগাযোগ করে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় তাদের ছাড়িয়ে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে গেছেন। সেই সূত্র ধরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরের শেষের দিকে পত্র লেখা হয়েছে।
যেহেতু উচ্চ আদালত বেশ কয়েকজনকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশনা দিয়েছেন সেহেতু সাজাভোগ শেষ হওয়া এদেরও সরকারি সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রশাসনের কাছে হস্তাস্তর করা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
আরএ/পিআর