বিশ্বাস হচ্ছে না আব্বু বিউটিকে হত্যা করেছে
হবিগঞ্জের আলোচিত বিউটি হত্যার ঘটনায় দায় স্বীকারের পর বাবার বিচার চাইলেন একমাত্র ছেলে সাদেক মিয়া। একইসঙ্গে নাতনি হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকলে নিজের ছেলে সায়েদ আলীর ফাঁসি দাবি করেন তার বাবা বৃদ্ধ সঞ্জব আলী।
নাতনিকে নৃশংসভাবে হত্যা সহ্য করতে পারছেন না তার নানি ফাতেমা বেগমও। তাই তার দেয়া তথ্যেই চাঞ্চল্যকর এ মামলার জট খুলে। তিনি নিশ্চুপ থাকতে না পারায় খুব দ্রুত এ মামলার রোমহর্ষক রহস্য বেরিয়ে আসে।
মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলতে পারেননি বিউটির বাবা সায়েদ আলী এবং হত্যার মূল নায়ক ময়না মিয়া। তারা উভয়েই অকপটে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। বর্ণনা করেছেন হত্যার রোমহর্ষক কাহিনী। এদিকে নিহত বিউটি আক্তারের বাড়ি এখন জনমানব শূন্য। খা খা করছে হত্যার নেপথ্যের নায়ক ময়না মিয়ার বাড়িও।
বিউটির নানি ফাতেমা বেগম জানান, ঘটনার রাতে বিউটিকে তার কাছ থেকে নিয়েছে তার বাবা সায়েদ আলী ও ময়না মিয়া। এরপর বলেছে তাকে হত্যা করেছে বাবুল মিয়া।
তিনি বলেন, কে হত্যা করেছে তা আমি দেখিনি। সেটি বলতেও পারব না। কিন্তু তার বাবা ও ময়না আমার কাছ থেকে এসে তাকে নিয়ে গেছে। তারা কি করেছে, কোথায় নিয়েছে, কে মেরেছে তা আমি দেখিনি, বলতেও পারব না। যদি তারা এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে তাহলে তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
নিহত বিউটির ভাই সাদেক মিয়া বলেন, এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আব্বু বিউটিকে হত্যা করেছে। মানতে পারছি না কোনোভাবেই। যদি সত্যিই বাবা এর সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তার কঠোর শাস্তির দাবি জানাই।
ব্রাহ্মণডোরার ইউপি সদস্য সাহাব উদ্দিন ফরিদ বলেন, এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বাবা তার মেয়েকে মেরে ফেলবে মানা যায় না। এমন ঘটনার নজির খুব কমই।
তিনি বলেন, গত ৫০ বছরেও এই এলাকায় এমন ঘটতে দেখিনি। কারও কাছ থেকে শুনিনিও কখনও এমনটি ঘটেছে। সারাক্ষণ এলাকার মানুষ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। সবার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বাবা এ খুনের সঙ্গে জড়িত। বাবা-মায়ের কাছে যদি সন্তান নিরাপদ না থাকে, তবে আর কোথায় তারা নিরাপদ?
বিউটির দাদা সঞ্জব আলী জানান, ঘাতক ময়নার প্ররোচনায় তার ছেলে সায়েদ আলী হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছে। ময়না মিয়ার ফাঁসি দাবি করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার ছেলে যদি এ ঘটনায় জড়িত থাকে তবে তারও ফাঁসি হোক।
গত ১৬ মার্চ রাতে লাখাই উপজেলা গুনিপুর গ্রামে নানার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তার।
১৭ মার্চ হাওর থেকে তার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে বিউটির কথিত প্রেমিক বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে। বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৮ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল মিয়া ও তার মা কলম চান বিবির বিরুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় মামলা করেন। গ্রেফতার হয় বাবুল ও তার মা কলম চান বিবিসহ তিনজন।
হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আনমনা হয়ে থাকতেন বিউটির বাবা মামলার বাদী সায়েদ আলী। মেয়ে হারানোর ছাপ তার চেহারায় ছিল না। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করেন।
একই আচরণ করেন তার আত্মীয় সম্পর্কের ভাই ময়না মিয়াও। এতেই পুলিশের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তারা খোঁজেন বিউটির নিখোঁজ হওয়ার স্থান তার নানার বাড়ি। তার নানি ফাতেমা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকে পুলিশ।
তিনি শুরুতেই সব বলে দেন। তার কাছ থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিউটিকে নিয়ে যান বাবা সায়েদ আলী। তার সঙ্গে ছিল ময়না মিয়া। হত্যার পরদিন তাকে বলা হয় কে বিউটিকে নিয়ে এসেছে সেটি যেন কেউ না জানে।
এসব শোনার পর অবাক হয় পুলিশও। চমকে ওঠে সবাই। তার সামনে এনে হাজির করা হয় ময়না মিয়াকে। ফাতেমা বেগমকে দেখে অবাক হয়। এ সময় উভয়কে সামনা-সামনি জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ময়না সব স্বীকার করে নেয়। নিয়ে আসা হয় বিউটির বাবা সায়েদ মিয়াকেও। তিনি শাশুড়িকে দেখে চমকে উঠলেও প্রথমে অস্বীকার করে। পরে স্বীকার করে।
একপর্যায়ে সব স্বীকার করে মেয়ে হত্যার জন্য অনুতপ্ত হয়। একে একে সায়েদ আলী ও ময়না মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়।
হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় দুইজন। ময়না মিয়া ছুরি চালায় এবং পলাতক খুনি বিউটিকে ধরে রাখে। তাকে গ্রেফতারে মরিয়া পুলিশ। খুব দ্রুত তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে জানায় পুলিশ।
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/এএম/এমএস