এনজিওকর্মী বাসন্তী রাণী ১০ বছর ধরে শেকলে বাঁধা
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে চুরির অভিযোগে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পায়ে শেকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে বাসন্তী রাণী (৩১) নামে এক নারী এনজিওকর্মীকে। তরুণ বয়স থেকে বেঁধে রাখায় বর্তমানে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন এক সময়ের ওই নারীকর্মী।
পরিবারের দাবি, তাকে ছেড়ে দিলে অন্যের জিনিসপত্র চুরি করে অথবা অন্যের কিছু হারালে চুরি না করেও তাকে অপবাদ দেয় স্থানীয়রা। বাসন্তী রাণী দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা ইউনিয়নের লক্ষীরহাট ডাঙ্গাপাড়া এলাকার হরিপদ কর্মকারের বড় মেয়ে। সোমবার রাতে স্থানীয়ভাবে তাকে বেঁধে রাখার বিষয়টি ফেসবুকের মাধ্যমে জানাজানি হয়।
স্থানীয়রা জানায়, লক্ষীরহাট ডাঙ্গাপাড়া এলাকার হরিপদ কর্মকারের দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে বাসন্তী রাণী দ্বিতীয়। হরিপদ কর্মকার পেশায় একজন কামার। ৮ শতক জমিতে ভিটে বাড়িটি তার সহায় সম্বল। ২০০৫ সালে বাসন্তীর বড়বোন গীতা রাণী মুসলিম ধর্মের এক ছেলেকে বিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করে। পরে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের নির্যাতনে মারা যায় বড়বোন গীতা। সেই সময় অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো বাসন্তী রাণী। বড় বোনের এমন ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সেই সময়ের তরুণী বাসন্তী রাণী।
এরপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (ব্র্যাক) কিশোরী স্বাস্থ্য পরিচর্যা সংক্রান্ত প্রকল্পে চাকরিও নেন তিনি। পরে রাজশাহীতে চলে যান ট্রেনিংয়ে। এক মাস ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরে তার মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করেন পরিবারের সদস্যরা। মাঝে মধ্যে সে অসুস্থ হলে খিঁচুনি দেখা দিত। পরিবারের দাবি, মানসিক রোগের চিকিৎসকসহ, ওঝা, কবিরাজের নানান পরামর্শে তাকে চিকিৎসা করানো হয়। তাকে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ খাওয়ানোর ফলে তার মাথার সমস্যা শুরু হয়। এরপর তার মাথা খারাপ হয়েছে এবং সুযোগ পেলেই মানুষের বাসায় চুরি করছে, এমন অপবাদে ২০০৬ সাল থেকে পায়ে শেকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখেন পরিবারের লোকজন। তবে এরই মধ্যে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মানসিকভাবে সুস্থ জানিয়ে ভর্তি না করিয়ে ফিরিয়ে দেন।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা ইউনিয়নের লক্ষীরহাট ডাঙ্গাপাড়া এলাকার হরিপদ কর্মকারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি কাঁঠাল গাছের সঙ্গে পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে বাসন্তী রাণীকে। এসময় ছবি তুলতে গেলে তিনি সাংবাদিকদের পরিচয় জানতে চান। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলেন এবং নিজেকে সুস্থ দাবি করেন। লেখাপড়া জানার কথা জিজ্ঞেস করায়, তিনি কাগজ কলম নিয়ে সুন্দর হাতের লেখায় নিজের নাম ও ঠিকানাও লিখে দেন। তার সঙ্গে কথা বলতেই সেখানে প্রতিবেশীদের ভিড় লেগে যায়। তরুণী বয়সে দেখতে বেশ ভালোই ছিল উল্লেখ করে প্রতিবেশীদের অনেকেই জানান, বাসন্তী রাণী সম্পূর্ণ সুস্থ। সে কারো পরোয়া না করে চলাফেরা করতো। বড় বোনের মতো ধর্ম পরিবর্তন করে সেও যাতে পালিয়ে বিয়ে করে না ফেলেন, এজন্য তাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে।
বাসন্তী রাণীর প্রতিবেশী শিউলি আক্তার বলেন, বাসন্তীকে দিয়ে তার ছোট ভাইয়ের বউ প্রতিদিন সকালে গৃহস্থলীর কাজ করান। অসুস্থতার জন্য সে ভালো করে কাজও করতে পারে না। তারপর বেঁধে রাখেন সারাদিন।
বাসন্তীর বাবা হরিপদ কর্মকার বলেন, মাঝে মাঝে সে মৃগি রোগীর মতো আচরণ করে। তাকে মানসিক চিকিৎসক ছাড়াও কবিরাজ, মাহানের (ওঝা) ওষুধ খাইয়েছি। বেশি করে ওষুধ খাওয়ার পর তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। তাকে ছেড়ে দিলে মানুষের অভিযোগের জন্য আমরা থাকতে পারি না। এজন্য প্রায় ১০ বছর ধরে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে।
বাসন্তীর ছোট ভাই রতন রায় জানায়, সে ব্র্যাকের একটি প্রকল্পে চাকরি করতো। রাজশাহীতে ট্রেনিং থেকে আসার পর তার নামে নানান অভিযোগ উঠে। এ সময় স্থানীয় একটি এনজিওতে (গ্রামীণ ব্যাংক) চুরির অপবাদ দেয়া হয় তাকে। পরে গ্রাম্য এক শালিস বৈঠকে তাকে সামলে রাখতে বলা হয়। এরপর থেকে তাকে বেঁধে রাখা হয়। এরমধ্যে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মানসিকভাবে সুস্থ বলে ফিরিয়ে দেন।
দেবীডুবা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাসন্তী রাণীকে এতোদিন ধরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিষয়টি জানতাম না। ফেসবুকের মাধ্যমে জেনেছি। তবে সে নাকি ভালোভাবে চলাফেরা করতো না। তার নামে নানান অভিযোগও ছিল। চেয়ারম্যান বলেন, আমি খোঁজ খবর নিচ্ছি এবং শেকল খুলে দেয়াসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থাও করবো।
সফিকুল আলম/এমএএস/এমএস