বশ মানাতে এত নিষ্ঠুরতা!
মা লক্ষ্মীর কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে চার বছরের আম্বিয়াকে। আম্বিয়াকে তৈরি করা হবে কামাই রোজগারের মাধ্যম হিসেবে। তাই পা ও গলায় দড়ি বাঁধা আম্বিয়া শিখছে মানুষের শেখানো বুলি। সাড়া না দিলেই দেয়া হচ্ছে কঠিন শাস্তি। তিন মাস চলবে এ ধারাবাহিক নির্যাতন।
আম্বিয়া চার বছর বয়সের একটি হাতি শাবকের নাম। হাতি শাবক আম্বিয়াকে দেয়া হচ্ছে তিন মাসের প্রশিক্ষণ। আঞ্চলিক ভাষার এর নাম ‘হাদানি’।
প্রাচীনকাল থেকেই পোশা হাতিকে প্রয়োজনে ব্যবহার করছে মানুষ। পাহাড় থেকে গাছ টেনে নামানো, সার্কাস, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেলা ও শারীরিক কসরত দেখানোর জন্য হাতি শাবককে দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। হাতির মাহুত (রাখাল) যখন সালাম দিতে বলে হাতি সালাম দেয়, টাকা নিতে বললে শুঁড় তুলে ইশারা করে রাস্তা ঘাটে টাকা চায়, সার্কাসে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ভাব প্রকাশ করে। এমন কত কত কসরত দেখায় হাতি যা আমাদের আনন্দ দেয়, আগ্রহ বাড়ায়। কিন্তু সব কিছুর পেছনে কাজ করে এক বর্বর প্রশিক্ষণ। যা যে কোনো মানুষকে আবেগ তাড়িত করবে।
মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া তিন মাসের এ প্রশিক্ষণ চলবে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। তিন মাস আম্বিয়াকে যেতে হবে প্রশিক্ষণ নামের নিষ্ঠুর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে।
পাঁচ প্রশিক্ষক দলের প্রধান আব্দুল মান্নান আসাম থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এখন দেশে কাজ করছেন আম্বিয়াকে নিয়ে। তিনি জানালেন এটাই প্রশিক্ষণের নিয়ম।
মা লক্ষ্মীকে কেন আলাদা করে বেঁধে রাখা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, মানুষের মতো হাতিরও সন্তানের প্রতি মমতা আছে, আবেগ অনুভূতি আছে। প্রশিক্ষণের সময় যে নির্যাতন করা হয় মা লক্ষ্মী কাছে থাকলে তা সইতে না পেরে মানুষের ওপর আক্রমণ করবে। এতে প্রাণহানীসহ বড় বিপদ হতে পারে। তাই মা হাতিকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।
নিষ্ঠুরতার প্রথম ধাপ মায়ের থেকে আলাদা করা। এর পরই শুরু হয় বর্বরতার চরম মাত্রা। চারদিকে উৎসাহী মানুষ আর মধ্যমাঠে চলছে আম্বিয়ার প্রশিক্ষণ। মাঠের মধ্যে গাছের গুড়ির সঙ্গে আম্বিয়াকে বেঁধে সামনে-পেছনে, পা ও গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছে বড় বড় দড়ি। প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতি শাবককে মালিকের ডাকে সাড়া দেয়ার উপায় শেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একেকটি পরিচিত শব্দ করছেন আর তাতে সাড়া না দিলে শক্ত বাশের লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে আম্বিয়াকে। আঘাতে আঘাতে বিক্ষত করা হচ্ছে, আম্বিয়া চেষ্টা করছে বাঁধন মুক্ত হতে কিন্তু নিষ্ঠুর মানুষের বুদ্ধির কাছে হেরে গিয়ে শুঁড় তুলে কাতরানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আম্বিয়ার।
এক পর্যায়ে কাঠের গুড়ি থেকে ছাড়িয়ে আম্বিয়াকে মাঠের চারপাশে ঘুরানো হয় বেশ কিছুক্ষণ। এটাই নাকি হাতির সঙ্গে মানুষের আন্তরিক সর্ম্পক গঠনে কাজে আসে। এভাবে বেঁধে রেখেই আবার চলে আম্বিয়ার চিকিৎসা। অর্থাৎ বিভিন্ন লতা পাতার মালিশ দেওয়া হয়। ভালো হয়ে গেলে আবার নির্যাতন চলে। উপস্থিত কৌতুহলী প্রতিটি মানুষের মনে দাগ কাটে আম্বিয়ার চিৎকার।
দিনের অর্ধেক সময় বেঁধে রেখে বাকি সময় মাঠ ঘুরিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিভিন্ন বিষয় ও মেয়াদী প্রশিক্ষণের এটা প্রাথমিক কোর্স। এ সময় হাতি শাবককে কলা গাছ, মিষ্টান্ন, বিভিন্ন ভালো খাবারও দিতে হয়।
আম্বিয়াকে যখন নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে রোজগারের জন্য তৈরি করা হচ্ছে আম্বিয়ার মা তখন পাশের হাড়ারগজ সংরক্ষিত বনে মালিকের রোজগারের কাজে ব্যস্ত। শুধু আম্বিয়া নয়, প্রতি বছর শীত মৌসুমে এই এলাকায় ৪-৫টি হাতি শাবককে একই নিয়মে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে।
সহকারী প্রশিক্ষক আব্দুল মতিন জানালেন, দুষ্টু বাচ্চাকে স্কুলের ম্যাডামরা যেভাবে শাস্তি দিয়ে লেখাপড়ায় ভালো করে তোলে তারাও তেমনই করছেন। প্রশিক্ষণের এক পর্যয়ে সময় জ্ঞান শেখানোর জন্য তাকে মুক্ত ঘরতে দেওয়া হবে। ঠিক সময়ে সে ফিরে আসবে। যদি না আসে তাহলে এ রকম আরো শাস্তি দেয়া হবে।
হাতির মালিক শাহাব উদ্দিন জানালেন বাংলাদেশে এটা ছাড়া ভিন্ন কোনো পদ্ধতি নেই। আরও ভালো কোনো পদ্ধতি থাকলে তারা সেটাই গ্রহণ করবেন। থাইল্যান্ড ভারতসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি এ নিয়মেই প্রশিক্ষণ দেখেছেন।
প্রাণী গবেষক তানিয়া রহমান জাগো নিউজকে জানান, কোনো প্রাণীর ওপর এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা অপরাধ। হাতি প্রশিক্ষণের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দে জাগো নিউজকে জানান, পোষা হাতিকে প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার কিন্তু প্রশিক্ষণকালে তাকে নির্যাতন করা যাবে না। এ ব্যাপারে প্রশিক্ষক ও হাতির মালিকদের সতর্ক করা হবে। প্রশিক্ষণের সেকেলে এ পদ্ধতি বদলানোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এফএ/এমএস